মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার ও মুক্তিকামনায় গঠিত বিশেষ বাহিনী নিউক্লিয়াসের সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ হত্যার ২৩তম বার্ষিকী আজ। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কালিদাসপুরে সন্ত্রাসবিরোধী একটি জনসভায় গুলিতে নিহত হন কাজী আরেফসহ জাসদের ৫ নেতা।
এ ঘটনায় আদালত ৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দিলেও তাদের ৪ জনই পলাতক। তবে আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীরা।
দণ্ডপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করা ও আরেফের স্মৃতি সংরক্ষণে ভাস্কর্য ও স্তম্ভ নির্মাণের দাবি স্বজন ও এলাকাবাসীর।
দৌলতপুরের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সন্ত্রাসবিরোধী জনসভার আয়োজন করে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ প্রধান অতিথির বৃক্তৃতা শুরু করলে শুরু হয় সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ। এতে কাজী আরেফসহ নিহত হন জেলা জাসদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন তফছের ও সমশের মণ্ডল।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কালিদাসপুরের বাসিন্দা জাহার আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জনসভায় বসে ছিলাম। শেষ বক্তা আরেফ সাহেব বক্তব্য রাখছিলেন। এর মধ্যে শত্রুরা চলে এলো। এ সময় আরেফ তাদের জিজ্ঞেস করে বাবারা কী চাও? জবাবে ওরা বলল- আমরা তোকেই চাই। এই বলে গুলি মারল। ভয়ে আমরা দৌড় মারলাম। আমার কোলের মধ্যে একটা ছেলে ছিল, ওকে রেখেই আমি দৌড় দেই।’
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বল্লগ আলী সর্দার বলেন, ‘ওই দিন মুসা চেয়ারম্যান আমাদের ডেকে এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আরেফ সাহেব আসবে। তোমরা সবাই আস। এ কথা শুনে বহু লোকজন আসল। আমিও আসলাম।
‘মিটিংয়ের শেষ বক্তা কাজী আরেফ বক্তব্য রাখছিলেন। এ সময় লোকমান সাহেব আসলেন। আরেফ সাহেব কথাটা বন্ধ করে বললেন, ভাই আপনি এখানে, আপনার তো আসার কথা না। লোকমান বলেছিলেন, আপনি এসেছেন শুনে আপনাকে দেখতে আসলাম। সেখানেই বক্তব্য চলাকালে সন্ত্রাসীরা এসে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ধরে জিজ্ঞেস করে আর গুলি করে। বলে- তোর নাম কী? শোনে আর গুলি করে। এভাবে ৫ জনকে মেরে ফেলল। এর মধ্যে মানুষ সব দৌড়ে পালাল। পরে সবাই এসে মরদেহগুলো তুলে দেয়া হলো। আর সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে করে চলে গেল।’
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম রফিক দাবি করে বলেন, ‘এই কালিদাসপুর স্কুল প্রাঙ্গণে কাজী আরেফ বা মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি পাঠাগার হোক।’ এ ছাড়া আরেফ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এলাকার তরুণরা যাতে তার সম্পর্কে জানতে পারে। তার আদর্শ বুকে ধারণ করতে পারে।’
বেদনাবিধুর ওই দিনের ওই সভার সঞ্চালক ছিলেন বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা জাসদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কারশেদ আলম। নিউজবাংলাকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পর দৌলতপুর থানার ওসি ইসাহাক আলী হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সিআইডির এএসপি নবকুমার দাসকে। ২০০০ সালে ২৯ জনকে আসামি করে তিনি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালত তা আমলে নিয়ে চার্জ গঠন করে। ২০০২ সালের ৭ জানুয়ারি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষ্য শেষে ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ১০ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়।
আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট উচ্চ আদালত ৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে অন্য ১৩ জনকে খালাস দেয়। কাজী আরেফসহ পাঁচ খুনের মামলায় ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি তিনজন আসামির ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। এ ছাড়া আসামি এলাচ উদ্দীন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এ মামলার ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ৫ আসামি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। তাদেরই একজন রওশন আলী।
হত্যাকাণ্ডের ২২ বছর পর ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক রওশন আলীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বর্তমানে পলাতক আছেন মান্নান মোল্লা, জালাল ওরফে বাসার, বাকের আলী ও জাহান আলী।
মামলার অন্যতম সাক্ষী কারশেদ আলম বলেন, ‘এই আসামিরা মামলার সাক্ষীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে রওশন আলীসহ সবার ফাঁসির রায় কার্যকরের জোর দাবি জানাই।’
একই দাবি জানান কাজী আরেফ আহমেদের ভাতিজা কাজী হুমায়ুন কবীর। এ ছাড়াও তিনি এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এত বড় একজন নেতাকে কয়েকজন সন্ত্রাসী হত্যা করবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এর পেছনে পরিকল্পনাকারী আছে। তাই তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহবান জানাই।’
তিনি জানান, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৬২ সালে বাঙালির মুক্তি কামনায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন। ১৯৭১ সালে আরেফ ছিলেন মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান এবং ছাত্রলীগের সমন্বয়কারী।
মিরপুর উপজেলার কচুবাড়িয়া গ্রামে কাজী বাড়িতেই কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। এই বাড়িতেই ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন কাজী আরেফ। তার সেই ঘর এখন ভেঙে পড়ছে। এই বাড়ি ঘিরে একটি কমপ্লেক্স করার দাবি তোলেন কাজী হুমায়ুন। বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে কিছু না হলে তার স্মৃতি রক্ষার্থে পারিবারিকভাবেই কিছু একটা করবেন। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছে।’