দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য ‘ইউনিক আইডি’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত সব তথ্য থাকবে। ইউনিক আইডি তৈরিতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীর ডাটা (তথ্য) সফটওয়্যারে এন্ট্রি দেয়ার কাজও। কিন্তু সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি দিতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা।
অনেক শিক্ষক সফটওয়্যারে ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রি দেয়াকে বলছেন শুধুই ‘ঘোরাঘুরির কারবার।’ কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইউনিক আইডির সফটওয়্যারে শিক্ষার্থীদের ডাটা এন্ট্রি দেয়ার পর শুধু ‘লোডিং’ লেখা আসতে থাকে, যা শেষ হতে ন্যূনতম ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। কখনও কখনও একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দিতে পুরো কর্মদিবসই (সকাল ৯টা থেকে ৫টা) শেষ হয়ে যায়।
ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রিতে শিক্ষকদের দুর্ভোগে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন মাধ্যমিক পর্যায়ের ইউনিক আইডির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মো. শামসুল আলম। সারা দেশে একসঙ্গে সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি দেয়ার কারণে সার্ভারে চাপ পড়ে এ সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সারা দেশে একসঙ্গে কাজটি করায় সার্ভার জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে একটি ডাটা এন্ট্রি দিতে অনেক সময় লাগছে।’
এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বিভাগ অনুযায়ী সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যাতে একসঙ্গে সারা দেশের শিক্ষকদের কাজ করতে না হয়। এতে সার্ভারের ওপর চাপ কমবে।’
খোঁজ নিয়ে যায়, অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দিতেই পূর্ণ কর্মদিবস লেগে যাচ্ছে। কখনও কখনও পূর্ণ কর্মদিবসেও একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন একাধিক শিক্ষক।
ব্যানবেইসের ভোগান্তি নিয়ে শিক্ষকদের ফেসবুক পোস্ট। ছবি: ফেসবুক
তেমনই একজন কবির হোসেন। শিক্ষকদের নিয়ে তৈরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি গ্রুপে তিনি লেখেন, ‘ইউনিক আইডির সার্ভার শুধু ঘোরাঘুরির কারবার, একটি আপলোডেই নার্ভাস। এ যেন শিক্ষক চটকানো সার্কাস।’
আরেকজন শিক্ষক তানজিনুর রহমানও ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ‘ব্যানবেইস কর্তৃপক্ষ ইউনিক আইডির এমন একটি সার্ভার তৈরি করেছে, যে সফটওয়্যারে কাজ করতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।’
ইউনিক আইডি তৈরির মতো সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে বলে মনে করেন আব্দুর জব্বার নামের আরেক শিক্ষক।
তিনি লেখেন, ‘নিম্নমানের ওয়েবসাইট, ওয়েবসাইটে ডোমেইনে হোস্টিং কম থাকায় ইউনিক আইডির কাজ করতে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি চরমে। ইউনিক আইডির মতো (সরকারের) প্রশংসনীয় কাজটি ভেস্তে যেতে বসেছে। অদূরদর্শী প্রকল্প পরিচালকের অপসারণসহ ওয়েবসাইট আপডেট করার দাবি জানাচ্ছি।’
ডাটা এন্ট্রিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন মোহাম্মদ হাসানুর। তিনি লেখেন- ‘ইউনিক আইডির ফরম পূরণে সার্ভার সমস্যা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়।’
ফেসবুকে একই ধরনের স্ট্যাটাস দিয়েছেন গোলাম আযম নামের একজন। তিনি লেখেন, ‘১৫ দিনে মাত্র ৩২টি আপলোড দেয়া সম্ভব হয়েছে।’
রানা আহমেদ নামের একজন লেখেন, ‘যারা ইউনিক আইডির কাজ করছেন, সার্ভার ঠিক না করা পর্যন্ত তাদের কাজ বন্ধ রাখা উচিত। এভাবে কাজ করা যায় না।’
মুহাম্মদ আব্দুস সালাম লেখেন, ‘ইউনিক আইডির কাজ করলে সবকিছু বাদ দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হবে। তাও কাজ হবে না।’
ঢাকার একাধিক স্কুলে খোঁজ নিয়েও ইউনিক আইডির সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রিতে শিক্ষকদের ভোগান্তিতে পড়ার সত্যতা পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের অধ্যক্ষ রাফিয়া আক্তারও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী কাজটি হচ্ছে। আমার ধারণা, একই সার্ভারে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থেকে কাজটি করা হচ্ছে বলে একটি ডাটা এন্ট্রি দিতেই অনেক সময় লাগছে। একটি তথ্য এন্ট্রি দিলে তা ভেরিফাই হওয়ার পরই পরের ধাপে যেতে হয়। এতেও অনেক সময় অপচয় হয়। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে সকাল ৯টায় শুরু করে বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর ডাটাই এন্ট্রি দেয়া সম্ভব হয়নি।’
ইস্কাটন গার্ডেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র চৌধুরীও বলছেন সার্ভার জটিলতায় ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রি দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দিতেই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। সার্ভার উন্নত করা না হলে বা বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া না হলে নির্ধারিত সময়ে সব শিক্ষার্থীর তথ্য এন্ট্রি সম্ভব নয়।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহারও ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রিতে ভোগান্তির কথা জানালেন।
তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দিতেই অনেক সময় লাগছে। কখনও কখনও এক দিনে একজন শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রি দেয়া সম্ভব হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে আমার দাবি এ সমস্যাটি খুব দ্রুত সমাধান করা হোক।’
বিভাগ অনুযায়ী এন্ট্রির শিডিউল
মাধ্যমিকপর্যায়ের (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি দেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ডাটা এন্ট্রি ও আপলোড শুরু হয় গত ১৭ জানুয়ারি, যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। এখন সার্ভার জটিলতায় ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রির সমস্যা সমাধানে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিভাগ অনুযায়ী সময় নির্ধারণ করে অফিস আদেশ জারি করে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)।
অফিস আদেশ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ১৪ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিভাগের জন্য ১ থেকে ১৬ মার্চ, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের জন্য ১৭ থেকে ৩১ মার্চ, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের জন্য ১ থেকে ১২ এপ্রিল এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের জন্য ১৩ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইউনিক আইডি কেন
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এক জায়গায় রাখার জন্য তৈরি করা হচ্ছে ইউনিক আইডি। শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে এই আইডি জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) রূপান্তরিত হবে।
ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরির দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। আর প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরি করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
কেন শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিক আইডি তৈরি করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলেই স্থানীয় সরকার বিভাগের অফিস অফ রেজিস্ট্রার জেনারেলের আওতায় তার জন্ম নিবন্ধন হয়। আর ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া সবার জন্য আছে জাতীয় পরিচয়পত্র। কিন্তু যারা প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-এর নিচে তারা এই সিস্টেমের বাইরে। এ জন্য তাদের সিস্টেমের মধ্যে আনতেই ইউনিক আইডি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
ফরমে যেসব তথ্য দিতে হয়
স্ট্যাবলিশমেন্ট অফ ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা চার পৃষ্ঠার ফরমে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ফরমে শিক্ষার্থীর নাম, জন্মনিবন্ধন নম্বর, জন্মস্থান, জেন্ডার, জাতীয়তা, ধর্ম, অধ্যয়নরত শ্রেণি, রোল নম্বর, বৈবাহিক অবস্থা, প্রতিবন্ধিতা (ডিজ-অ্যাবিলিটি), রক্তের গ্রুপ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কি না, মা-বাবার নামসহ বেশ কিছু তথ্যের ঘর রয়েছে।
বৈবাহিক অবস্থার অপশন হিসেবে অবিবাহিত, বিবাহিত, বিধবা, বিপত্নীক ছাড়াও স্বামী-স্ত্রী পৃথক বসবাস, তালাকপ্রাপ্ত, বিয়েবিচ্ছেদের ঘরও রয়েছে ফরমে।