রেলের শহর নীলফামারীর সৈয়দপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০০ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক; যাদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান কিংবা প্রশিক্ষণ। পুরোনো যন্ত্র ব্যবহার করেই তারা তৈরি করছেন কৃষিতে ও শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত মেশিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাবনাময় খাত। সরকার এ খাতটিকে রপ্তানিমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিলেও এ খাত বিকাশে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না এখানকার উদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, নির্দিষ্ট জোন না থাকা, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শহরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের বিকাশ ঘটছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ শিল্পের বিকাশে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানায় সাবকন্ট্রাক্ট হিসেবে যন্ত্রাংশ সরবরাহ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তিতে সহজলভ্যতা, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, আধুনিক মেশিনের ব্যবহার এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট জোন স্থাপন করা প্রয়োজন।
তারা মনে করেন, এসব সুবিধা নিশ্চিত করা হলে একদিকে যেমন এ শিল্পের বিকাশ ঘটবে, অন্যদিকে লাভবান হবে সরকার। আর চীন কিংবা জাপান থেকে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উৎপাদিত যন্ত্র আমদানি করার প্রয়োজন হবে না, বরং বাংলাদেশই রপ্তানি করতে পারবে এসব যন্ত্রাংশ।
সৈয়দপুর শহর ঘুরে দেখা গেছে, শহরের যত্রতত্র ভাড়া দোকানঘর কিংবা বাড়ি-ঘরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। কোনো দোকানে ৫ জন, কোথাও ১০ জন আবার কোথাও ১৫ জন নিয়ে চলছে তাদের এই কর্মযজ্ঞ।
এই পেশায় সংসার চলে শ্রমিক ইমরান হোসেনের। স্বামী-স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে চারজনের সংসার চালাতে হয় তাকে। এখন দিন হাজিরা হিসেবে পান ৭০০ টাকা।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে ৩০ টাকা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এরপর দৈনিক ৩০০ টাকা থেকে এখন দৈনিক ৭০০ টাকা পাচ্ছি। এই দিয়েই আমার সংসার চলে।’
যে শিল্পে তিনি কাজ করেন, এর ওপর তার নেই কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান। তার ভাষ্য, ‘আমাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান নেই। বাবা এই কাজ করেছিলেন, আমিও দেখে দেখে শিখেছি। ভারী ভারী মেশিনে কাজ করতে হচ্ছে এখন।’
আরেক শ্রমিক সুলতান আলী বলেন, ‘অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। কারণ এখন যে মেশিনগুলো ব্যবহার হচ্ছে তা অত্যন্ত পুরোনো। মান্ধাতা আমলের মেশিন।’
এ সময় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। কেউ আমাদের খবর রাখেন না। কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাই না।’
ফয়সাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের স্বত্বাধিকারী মঈন আনসারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানকার যন্ত্রের অনেক চাহিদা রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামেও যায়। কিন্তু আমরা সরবরাহ করতে পারি না।
অর্থনৈতিক সংকটের বিষয় উল্লেখ তিনি বলেন, ‘দিনে দিনে কাঁচামালের মূল্য বাড়ছে, সে হিসেবে অর্থ সংকুলান হয় না। যে জিনিস ৬০ টাকায় কিনতাম, এখন সেটি ১০০ টাকায় কিনতে হয়। যত ব্যবসায়ী আছেন, সবাই নানা সংকটে পড়েছেন। যেভাবে চলছে, তাতে ভবিষ্যতে আমরা অন্ধকার দেখছি।’
শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে মেশিন তৈরি করা হয় জানিয়ে ব্যবসায়ী সানি খান বলেন, ‘জুট মিল, ময়দা মিল, তামাক ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল মিলে এক্সপেয়ার পার্টস রিপেয়ার বা নতুন করে বানিয়ে দেয়া হয়। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে খড় কাটা, সুতা বানানো, ধান ভাঙা মেশিনসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করছি।
‘এ ছাড়া ভারত বা চীনের যন্ত্রও আমরা মেরামত কিংবা নতুন করে তৈরি করে দেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বৃহৎ রেলকারখানা সৈয়দপুরে অবস্থিত। এখানকার কাজ আমরা করতে পারি না। অন্যরা কাজ পায় তারা আমাদের দেয়, সেগুলো আমরা তৈরি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেই। অথচ এই কাজ আমাদের পাওয়ার কথা।’
এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা চান মাসুম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন দুলাল। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ হাজার হাজার মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। আমরা সরকারকে দিচ্ছি, কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।
‘আমরা ব্যাংক ঋণ পাই না, এর জন্য মর্গেজ চায়। এটা তো আমার নেই। আমরা খোলামেলা জায়গায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি।’
এই শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট জোনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় যদি নির্দিষ্ট একটি জোন করে দেয়া হয়, তাহলে এক বাউন্ডারিতে কাজ করতে পারব এবং এক পল্লিতে থাকতে পারব। আমরা মান্ধাতা আমলের যন্ত্র ব্যবহার করছি, অথচ লেটেস্ট টেকনোলজি এসেছে, কিন্তু আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এটাতে সরকারকে সহায়তা করতে হবে।’
কৃষিতে আমাদের কত ভূমিকা অথচ আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের উৎপাদিত মেশিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। সরকার যে মেশিন ৬০ থেকে ৭০ লাখ দিয়ে কিনে আনছে, বিদেশ থেকে ওই মেশিন আমরা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় তৈরি করে দিতে পারি। ফলে সরকারের অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির পরিচালক ও সৈয়দপুর পৌরসভার কাউন্সিলর এরশাদ হোসেন পাপ্পু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার ধোলাইখালের পর সৈয়দপুরের অবস্থান। এই শহরে এই শিল্পের সঙ্গে ৫০০ প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার শ্রমিক জড়িত। অথচ তারা আজ উপেক্ষিত।’
আফসোস নিয়ে তিনি বলেন, ‘কৃষিতে আমাদের কত ভূমিকা অথচ আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের উৎপাদিত মেশিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। সরকার যে মেশিন ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা দিয়ে কিনে আনছে বিদেশ থেকে, ওই মেশিন আমরা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় তৈরি করে দিতে পারি। ফলে সরকারের অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।’
‘আমাদের শিল্প সম্প্রসারণ হলে মেশিন আমদানি নয়, বরং বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারবে।’
জানতে চাইলে বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে সাবকন্ট্রাক্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঋণের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
‘নির্দিষ্ট একটি জোনের যে বিষয়টি এসেছে, এটি নিয়ে আমরা ভাবছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এটি সম্ভব কি না, দ্রুত এর উদ্যোগ নেয়া হবে।’