বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ওয়েবসাইট এক বছর ধরে ‘ডাউন’। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে- এমন একটি পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়েছে।
‘প্রবাসের খবর’ নামে একটি ফেসবুক পেজে ১২ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত পোস্ট দেয়া হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত এটি এক হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে, এতে রিঅ্যাক্ট করেছেন ৩ হাজার ৬০০-এর বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী।
এই তথ্যের সত্যতা অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। ‘প্রবাসের খবর’-এর ফেসবুক পেজে একে একটি সংবাদমাধ্যম হিসেবে দাবি করা হয়েছে। তবে যে ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেয়া হয়েছে সেটি খোলা যায়নি। ফেসবুকে যে ফোন নম্বরটি রয়েছে, তার কান্ট্রি কোড থেকে বোঝা গেছে পেজের নিয়ন্ত্রক ওমানে থাকেন।
‘প্রবাসের খবর’-এর দাবি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ওয়েবসাইট এক বছর ধরে ‘ডাউন’। তবে মঙ্গলবার দুপুরেও ওয়েবসাইটটি (https://www.biman-airlines.com/) সচল দেখা গেছে। সেখানে বিমানের বিভিন্ন সেবা নিয়ে তথ্যের লিংকগুলোতেও ঢুকতে সমস্যা হয়নি।
ওয়েবসাইট নয়, সমস্যা অনলাইন টিকিট বুকিংয়ে
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ওয়েবসাইটে কোনো সমস্যা না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে অনলাইনে টিকিট বুকিংয়ের সুবিধা।
অনলাইনে বিমানের টিকিট বিক্রি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইনস এজেন্ট পদ্ধতিতে টিকিট বিক্রি বাদ দিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টিকিট কেনাবেচাকে উৎসাহিত করছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান।
বিমান যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করছিল, সেটি গত বছরের ১১ আগস্ট থেকে বন্ধ। সে সময় বিমান সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, খুব শিগগিরই ওয়েবসাইটটি ফের চালু হবে, তবে ছয় মাসেও তা হয়নি।
অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধের কারণ সম্পর্কে ১১ আগস্ট বিমানের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস দেশীয় সার্ভিস প্রোভাইডারদেরকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে একটি প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেয়। তবে
প্রতিষ্ঠানটি বিমানের প্রত্যাশিত কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপে, বারবার ব্যর্থ হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘অবশেষে ১০ আগস্ট, ২০২১ থেকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে বিমানকে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানে বিরত হয় এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস গ্রহণ করে।’
অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধের পর থেকে বিমানের বিক্রয় কার্যালয় ও ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি চলছে। এতে বিমানের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন যাত্রীরাও।
বিমানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, ২০১৯ পর্যন্ত অনলাইনে তাদের টিকিট বিক্রির প্ল্যাটফর্ম ছিল বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জ্যাপওয়েজ। তবে সে সময় টিকিট রিফান্ড ও ভুল টিকেটিংসহ নানা জটিলতায় পড়তে হয় বিমানকে। টিকিট কাটতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ার অভিযোগ ছিল নিয়মিত। এ কারণেই পরে ট্রাভেল শপ নামে একটি দেশি প্রতিষ্ঠানকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, সময়মতো সার্ভারের ভাড়া পরিশোধ না করায় সার্ভার সেবা প্রদানকারী সংস্থা অ্যামাজন বিমানের সার্ভারটি বন্ধ করে দেয়। এতেই তৈরি হয় বিপত্তি। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না বিমানের কোনো কর্মকর্তা।
এভিয়েশেন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহেদুল আলমের মতে, অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধ থাকায় যাত্রী এবং বিমান দুপক্ষই ক্ষতির মুখে পড়ছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রযুক্তির যুগে বসে বিমান প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছে না এটা অবিশ্বাস্য। ছয় মাস ধরে টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইট বন্ধ- এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিমান যে প্রতিবছর লোকশান গুনছে এটিও তার একটি কারণ। আগের ওয়েবসাইটটাও যে খুব ভালো ছিল এমন নয়। তারপরেও সেটা দিয়ে টিকিট কাটা যেত।
‘কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, অবিবেচনা ও কাজ করার অনীহার বিষয়টিই প্রকাশ পাচ্ছে।’
কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করলে তাদের কিছু কমিশন দিতে হয়। তার ওপর তাদের ইনটেনসিভ দিতে হয় এবং আইএটিএর (ট্রাভেল এজেন্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন) কিছু চার্জ আছে, সেটিও পরিশোধের বিষয় রয়েছে। কোনো এয়ারলাইনস ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করলে সেই টাকা প্রথমে যাবে আইএটিএর ফান্ডে, তারপর সেটি আসবে এয়ারলাইনসের অ্যাকাউন্টে। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ।
‘আর অনলাইনে টিকিট বিক্রি করা হলে সরাসরি এয়ারলাইনস টাকাটা পেয়ে যাচ্ছে। তার ওপর যে কমিশন ট্রাভেল এজেন্টকে দিতে হয়, এয়ারলাইনস চাইলে অনলাইনের টিকিট ক্রেতাদের সেটি ডিসকাউন্টও দিতে পারে। এতে এয়ারলাইনস ও যাত্রী দুপক্ষই লাভে থাকে।’
বিমানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রি শুরু হতে আরও অন্তত এক মাস সময় লাগবে।’
প্রবাসের খবরের ফেসবুক পেজে পোস্টটি দেয়া হয় ১২ ফেব্রুয়ারি
মধ্যপ্রাচ্যে বিমানের ভাড়া সবচেয়ে বেশি?
‘প্রবাসের খবর’-এর পোস্টে দাবি করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীদের কাছ থেকে অন্য এয়ারলাইনসগুলোর তুলনায় বেশি ভাড়া নিচ্ছে বিমান। তবে এর সঙ্গে একমত নন ট্রাভেল এজেন্টরা।
ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব সভাপতি মানসুর আহমেদ কালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিমানের চেয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর টিকিটের দাম অনেক বেশি। ৪০ হাজার টাকার যে টিকিট সেটি বর্তমানে এক লাখ ২০ হাজার টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। এমিরেটস, কাতার এয়ার, জাজিরা এয়ার অনেক বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছে। এটার বড় কারণ টিকিটের কোনো ফিক্সড রেট নেই।’
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নেয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করেন মানসুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের ব্যর্থতা বলেই আমি বলব। তারা কেন বলছে না বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোকে যে, তোমরা এর চেয়ে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করতে পারবা না।’
যাত্রী ভোগান্তি কমাতে গত ৪ জানুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের ‘সর্বোচ্চ ভাড়া’ নির্ধারণ করে দেয় বিমান। সাধারণত এয়ারলাইনসগুলো সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করলেও সর্বোচ্চ ভাড়া ঠিক করার নজির খুব বেশি নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের ৫ রুটে বিমানের সর্বোচ্চ ভাড়া
ঢাকা-জেদ্দা একমুখী ইকোনমি সর্বোচ্চ ভাড়া এখন ৬৪ হাজার ৮২০ টাকা। ঢাকা-রিয়াদ/দাম্মাম একমুখী ইকোনমি সর্বোচ্চ ৬৩ হাজার ১২৩ টাকা, ঢাকা-দুবাই একমুখী ইকোনমি সর্বোচ্চ ভাড়া ৬২ হাজার ৭৮৪ টাকা, ঢাকা-আবুধাবী একমুখী ইকোনমি সর্বোচ্চ ৫৮ হাজার ৫৪২ টাকা।
‘জাতীয় দৈনিক’ থেকে তথ্য পাওয়ার দাবি করছে প্রবাসের খবর
বিমানের ওয়েবসাইট ‘ডাউন’-এর দাবির ভিত্তি জানতে প্রবাসের খবরের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে বার্তা পাঠায় নিউজবাংলা।
এরপর আরমান চৌধুরী নামে পেজের অ্যাডমিন প্যানেলের একজন জানান, তারা তথ্যগুলো সরাসরি কোনো উৎস থেকে নেননি।
আরমান বলেন, ‘পেস্টুন টি (ফেস্টুনটি) দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক থেকে নেয়া।’
কোন দৈনিক- সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘বিমান বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভাড়ার বিমান।’
বিমানের ওয়েবসাইট সচল পাওয়া যাচ্ছে এমন তথ্য জানালে আরমান বলেন, ‘পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে কিছুটা হয়তো ঠিক করছে, তবে এখনও পরিপূর্ণ ঠিক হয়নি।’
তিনি দাবি করেন, ‘গোটা দুনিয়ার রাষ্ট্রীয় যত বিমান সংস্থা রয়েছে সব থেকে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করে থাকে আমাদের বাংলাদেশ বিমান।
‘পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে দেখেন, মধ্যপ্রাচ্যের যাতায়াত টিকিট তাদের কত আর আমাদের কত? কোনো কোনো সময় তো ৩-৪ গুণ বেশি আমাদের দেশের টিকিটের মূল্য।’
‘প্রবাসের খবর’-এর ঠিকানা বা তাদের ওয়েবসাইট কেন খুলছে না- সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো জবাব দেননি আরমান চৌধুরী।