করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। টাকার যোগানে দুই হাত খুলে দিয়েছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটেও বড় অঙ্কের বরাদ্দ রয়েছে, কিন্তু অবারিত সুযোগ পেয়েও খরচের হাত খুলতে পারছে না স্বাস্থ্য খাত।
ব্যয় করতে না পারায় এই খাতে বরাদ্দ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সোয়া তিন হাজার কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে।
চলতি বছরে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ রয়েছে সব মিলে ১৭ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। খাত হিসেবে এটি চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ। তবে এ পর্যন্ত এই বিশাল বরাদ্দের মাত্র ১৩ শতাংশের মতো খরচ হয়েছে।
এ অবস্থায় ব্যয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সংশোধিত এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ১৯ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৫২ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ও কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আরএডিপি বা সংশোধিত এডিপি নেয়া হয় সাধারণত মার্চ থেকে জুন- এই চার মাসের জন্য। এখানে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে মন্ত্রণালয়গুলোর চাহিদার ভিত্তিতে এবং প্রকল্পের গুরুত্ব অনুসারে বরাদ্দ দেয়া হয়।
‘ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে আমরা বসেছি। এখানে মন্ত্রণালয়গুলোর এ পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন বা খরচের হিসাব করে তাদের শেষ সময়ের বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয়। যাদের বাস্তবায়ন কম, তাদের কাছ থেকে নিয়ে বাস্তবায়ন বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তা বরাদ্দ করা হয়। স্বাস্থ্য খাতও যেমন চেয়েছে, গুরুত্ব বুঝে তেমন বরাদ্দই দেয়া হবে।’
এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতের বেশির ভাগ টাকা রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অনুকূলে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বরাদ্দ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
গত জুলাই-ডিসেম্বর ৬ মাসে এ বিভাগ খরচ করেছে মাত্র ১ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। বরাদ্দ অনুপাতে খরচ হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ অনুপাতে খরচ কিছুটা বেশি হলেও জাতীয় গড়ের চেয়ে তা কম। ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে এ বিভাগ খরচ করেছে ৫৬৫ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ। জানুয়ারি পর্যন্ত এডিপির জাতীয় গড় ২৪ শতাংশের মতো।
করোনার মধ্যে পর পর দুই বছর স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন চিত্র দেখা গেছে। ব্যয়ের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাত দৈন্যদশা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না।
চলতি অর্থবছরে এডিপির ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পেয়েছে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অথচ এডিপি বাস্তবায়নের দিক দিয়ে সংস্থাটি পড়ে আছে ৫২তম অবস্থানে।
এমনকি শীর্ষ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে।
স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো
চলতি বছর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৪৬টি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে করোনাসংশ্লিষ্ট দুটি প্রকল্পও আছে। ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডামিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি। আর ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকার ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স’ প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।
প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি’ও রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এই কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। গত সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে চলমান কর্মসূচিতে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এই বিশাল অর্থ খরচের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
তবে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের সামর্থ বিবেচনায় এই বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই এক কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে ২০টি প্রকল্প রয়েছে।
এ ছাড়াও রয়েছে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, বিদ্যমান হাসপাতাগুলোতে বিভিন্ন নতুন ইউনিট খোলা ও সক্ষমতা বাড়ানোর ১৫টি প্রকল্প।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে গত দুই বছরের উন্নয়ন বাজেটে সরকার বেছে বেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এই খাতে কাজ হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে বেশি। অথচ প্রায় দুই বছর হতে চলল, এই খাতে এডিপি বাস্তবায়ন বাড়াতে পারছে না। খরচের সামর্থ্য না থাকায় তাদের বরাদ্দে লাগাম টানছে সরকার।
তারা বলছেন, শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ প্রয়োজন।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমে আসায় দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের কাজ দেখে তা মনে হচ্ছে না।
‘করোনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে এ খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর উপায় ছিল, কিন্তু তাদের সক্ষমতা বাড়েনি। বলা যায়, তারা নিজেদের সক্ষমতা বাড়ায়নি। এখানে নানা অনিয়মের কারণে এমনটি হচ্ছে। তাই তাদের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ফেরত যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরও এই খাত থেকে বড় অঙ্কের টাকা ফেরত গেছে। বাকি অর্থও বছরের অবশিষ্ট সময় ঠিকমতো ব্যয় করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ খাতের সামর্থ্য বাড়াতে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেয়া উচিত। একই সঙ্গে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, মূলত সংশোধিত এডিপি প্রণয়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে চাহিদা চাওয়া হয়। পরে কমিশনের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বয় সভায় চাহিদা প্রস্তাব, বাস্তবায়ন সক্ষমতা ও গুরুত্ব পর্যালোচনা করে খাতভিত্তিক বরাদ্দ তৈরি করা হয়।
চূড়ান্ত বরাদ্দ প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় (এনইসি) অনুমোদিত হয়। আগামী মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এনইসি সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ৯ লাখ টাকার এডিপি অনুমোদন দেয়া হয় গত জুনে। এতে সরকারি অংশ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে সরকারি অংশ না কমলেও বৈদেশিক অর্থায়ন ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা কমানোর কথা ভাবছে সরকার।