করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার পর দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। প্রতি মাসে রেকর্ড হচ্ছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ৮৬৫ কোটি (৮. ৬৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৭৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিপুল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা খরচ হতে দেখা যায়নি।
এর আগে সর্বোচ্চ এলসি খোলার পরিমাণ ছিল নভেম্বর মাসে ৮১০ কোটি ৭০ লাখ (৮. ১০ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের মাস অক্টোবরে ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০৭ কোটি ৫৪ লাখ) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা মতো। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৬৩ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ছয় মাসে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে দেশে।
আর এলসি খোলার এই হিড়িকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভেও টান পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করায় সে সব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গেছে। দুই বছরের মহামারির পর আগামী দিনগুলোতে সেই চাহিদা আরও বাড়বে।
সে চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে। বেড়েছে এলসি খোলার পরিমাণ।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের আতঙ্কও কেটে গেছে। বাংলাদেশসহ সব দেশের অর্থনীতিই করোনার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। সবমিলিয়ে আমদানিতে জোয়ার দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে বলে জানান তারা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার এলসি খোলার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও অন্য পণ্য আমদানিতে; সেটা ৬৪৩ কোটি (৬.৪৩ বিলিয়ন) ডলার, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৫২ শতাংশ বেশি।
সুতা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ২৫২ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। তুলা ও সিনেথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৮৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের। বেড়েছে ৩১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
রাসায়নিক দ্রব্য ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৭৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এছাড়া ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৬০ কোটি ডলারের; বেড়েছে ৩১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ৩২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৩৯০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এ ছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ২০৩ কোটি ৫৩ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি; ১২৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩২ কোটি ১২ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৬০৯ শতাংশ। গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার। বেড়েছে ৫৭ শতাংশ।
চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৪৫ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি ৮৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৯০ কোটি ডলারের; বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
ছয় মাসের পাঁচ মাসের পণ্য আমদানির এলসি খোলার এই তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রপ্তানি বাড়ছে। রাজস্ব আদায়ে গতি এসেছে। রেমিট্যান্সে বেশ ধাক্কা লেগেছিল; ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সেটাও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছে। অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। আর এ সব কারণেই আমদানি বাড়ছে।’
এর ইতিবাচক প্রভাব আগামী দিনগুলোতে বিনিয়োগে পড়বে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। জিডিপির ৩১/৩২ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যেটা ৩৭/৩৮ শতাংশ হওয়া উচিৎ। দেশে বিনিয়োগের একটা আবহ তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল এই বছরেই চালু হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎ কেন্দ্র্রসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এ সব মেগা প্রকল্পকে ঘিরেই আমদানি বাড়ছে।’
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘তৈরি পোশাকসহ সব পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর ফলে পোশাকসহ অন্যান্য খাতের কাঁচামাল আমদানি বেড়ে গেছে। মেগা প্রকল্পগুলোকে ঘিরেও অনেক পণ্য, যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম আমদানি হচ্ছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে; অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হচ্ছে।’
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, যা ছিল আগের (২০১৮-১৯) অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ কম।
রিজার্ভে টান
আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি রিজার্ভও কমছে, নেমে এসেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার হিসেবে বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত বছরের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
কিন্তু আমদানি বাড়ায় গত পাঁচ মাস ধরে রিজার্ভ ৪৫ থেকে ৪৬ ডলারের মধ্যে অবস্থান করছে।