প্রকাশ্য বিরোধ, ভিন্নমত, পাল্টাপাল্টি বক্তব্যসহ একে অন্যকে দোষারোপ করে বার বার আলোচনায় এসেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ও আলোচিত জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। যতোই দিন গড়িয়েছে, ততই তাদের বিরোধ তীব্র হয়েছে। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দিন শেষ কার্যদিবসে একই ভবনে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে সেই বিরোধ আরও প্রকাশ্য করলেন তারা।
সোমবার নির্বাচন ভবনে লেকভিউ চত্বরে আয়োজিত বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে সিইসি হুদার সাথে সঙ্গী হননি ইসি মাহবুব। হুদার সঙ্গী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসি রফিকুল ইসলাম এবং ইসি কবিতা খানম। সিইসি যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, মাহবুব তালুকদার তখন বসেছিলেন নিজ কার্যালয়ে। আধাঘণ্টা পরে সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব তালুকদার দাবি করেন, ‘মুক্তভাবে কিছু কথা বলতেই’ তার পৃথক সংবাদ সম্মেলন।
সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব তালুকদারের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে কথা বলতে রাজি হননি নূরুল হুদা। তিনি বলেন,‘মাহবুব তালুকদার সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। একটা লোক এখানে নেই, তার অনুপস্থিতিতে কিছু বলতে চাই না।’ নিজ কক্ষে মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পাঁচ বছর আমরা একত্রে ছিলাম। পরবর্তী সময়েও আমরা একত্রে থাকব।’
এদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে রোববার রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্টকার্ড বিতরণ অনুষ্ঠানে ‘অসুস্থতার কারণে’ উপস্থিত না থাকলেও ওইদিনই বিকেলে রাষ্ট্রপতির সাথে বিদায়ী সাক্ষাতে অংশ নিয়েছিলেন আলোচিত কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সমান সুযোগ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেয়ার মধ্য দিয়ে সিইসি হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার তালুকদারের বিরোধ প্রকাশ্য পায়। সেই বিরোধের ক্রমশ ঘণীভূত হয়েছে। কমিশনের মেয়াদ ফুরাতে যখন মাত্র ১৭ দিন বাকি, তখন চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে আরেক দফা তর্কযুদ্ধে নামলেন সিইসি ও ইসি মাহবুব তালুকদের।
হুদা কমিশনের অপর তিন কমিশনারকে কখনও এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। সিইসি ও ইসি তালুকদারের বিরোধ নিয়েও কখনও কোনো মন্তব্য করেননি তারা। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নবাণেও নীরব থেকেছেন তারা।
২০২১ সালের ৩ মার্চে ভোটার দিবসের আলোচনা সভায় যোগ দেন সিইসি নূরুল হুদা। ওই আলোচনায় শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি (ইসি মাহবুব) বই লেখার রসদ খোঁজেন।’
সিইসির সেই ‘আশঙ্কা’ অবশ্য সত্য হতে চলেছে। কারণ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার নির্বাচনের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখার কাজ চূড়ান্ত করে ফেলেছেন বলে জানা গেছে।
কবি ও শিশু সাহিত্যিক হিসেবে মাহবুব তালুকদারের পরিচিতি আছে। শিশু সাহিত্যের জন্য ২০১২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি।
কে এম নুরুল হুদা সরকারের সচিব ছিলেন। এছাড়া ঢাকা সিটি করপোশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর নির্বাচন ভবনে সিইসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘(নির্বাচনে) লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে। পুলিশ আমাদের কথা মান্য করে।’
ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর আরেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েও এ কথার পুনরাবৃত্তি করেন সিইসি।
কিন্তু কমিশনের প্রধান ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন মাহবুব তালুকদার। তার দুদিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর মাহবুব তালুকদার নিজ দপ্তরে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘আমি মনে করি না নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা এখন অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে।’
নির্বাচনি পরিস্থিতি দেখতে রাঙ্গামাটি সফরে গিয়ে মাহবুব তালুকদারকে তার বক্তব্যের জন্য ‘মিথ্যেবাদী’ আখ্যা দেন সিইসি।
পরদিন আবারও লিখিত বক্তব্য নিয়ে হাজির হন মাহবুব তালুকদার। সহকর্মীর বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ১৮ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটিতে বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে আমি মিথ্যা কথা বলেছি। আমি তার বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ এ কথা বলে তিনি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, সিইসিসহ সব নির্বাচন কমিশনার সমান।’
২০২১ সালের জাতীয় ভোটার দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সামনাসামনি বিতণ্ডায় জড়ান এই দুজন। সেদিন কমিশন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সমালোচনা করে আসা ইসি মাহবুব তালুকদারের সামনে নিজের ক্ষোভ ঝাড়েন সিইসি। তিনি বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে হেয়, অপদস্থ ও নিচে নামানোর জন্য যা করা দরকার, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সবই করে চলেছেন।’
সিইসি আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসিকে হেয় করে চলেছেন কমিশনের এই সদস্য।’
সিইসি যখন এসব কথা বলছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মাহবুব তালুকদার তখন অস্বস্তিতে পড়েন। তবে মঞ্চ ছেড়ে যাননি তিনি। ওই সময় গোটা অডিটোরিয়ামে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা
সিইসি আরও বলেছিলেন, ‘ভেবেছিলাম ভোটার দিবস হিসেবে তিনি কিছু বলবেন; কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন। ইসিকে কতখানি হেয় করা যায়, কতখানি নিচে নামানো যায়, অপদস্ত করা যায় তা তিনি করে চলেছেন।’
সে সময়ে সিইসি অভিযোগ করে বলেন, ‘নিজের বই লেখার প্রস্তুতির জন্যই’ কমিশনের নানা নেতিবাচক তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করে থাকেন নির্বাচন কমিশনার তালুকদার।
এদিকে, গত ৫ জানুযারি চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ‘ভোটের আগে ও পরে’ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় ব্যালট পেপারের নিরাপত্তা দিতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন মাহবুব তালুকদার। পরদিন গত ৬ জানুয়ারি মাহবুব তালুকদার মিথ্যা কথা বলেন বলে অভিযোগ করেন নূরুল হুদা।
তিনি বলেন, ‘ওনার কথার কোনো সঙ্গতি নেই। উনি এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলেন। হয়তো ওনার কোনো এজেন্ডা আছে, সেটাই বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচন কমিশনকে হেয় করতে এ কথা বারবার বলেন।’
গত ২৭ জানুয়ারি মাহবুব তালুকদারের প্রসঙ্গে কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘তিনি একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি। কখনও আইসিইউ, সিসিইউতে থাকেন। তিনি সিঙ্গাপুরে ট্রিটমেন্ট করেছেন। ভারতে ট্রিটমেন্ট করেছেন। বছরে প্রায় ৩০-৪০ লাখ টাকার ট্রিটমেন্ট করেন। এটা আমাদের নির্বাচন কমিশন বহন করে।’
কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে সিইসি আরও বলেন, ‘এখন আইসিইউ, সিসিইউ-এর কথাগুলো, তার নিজস্ব অসুস্থতার ওখান থেকে কোট করে এনেছেন কিনা সেটা জানি না।’
এরপর ২৮ জানুয়ারি গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান মাহবুব তালুকদার। নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন অবস্থানের কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ‘প্রতিহিংসা’ চরিতার্থ করার ‘নিকৃষ্ট পথ’ বেছে নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এরপর থেকে এ দুজন পরস্পরকে এড়িয়ে চলেছেন এমনকি কমিশনের দৈনন্দিন কাজ ও বৈঠকেও। নির্বাচন ভবনে ৩ ফেব্রুয়ারি সবশেষ কমিশন সভাতেও তাদের দেখা হয়নি। ওইদিন ‘অসুস্থ থাকায়’ বৈঠকে আসেননি মাহবুব তালুকদার।
মুজিবনগর সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সময়ে উপসচিব মর্যাদার ‘স্পেশাল অফিসার', শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব তালুকদার।
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তাকে ‘বিএনপির মনোনীত’ বলে অভিযোগ করেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা।