বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চিকন চালের জৌলুসেও কমেনি মোটা চালের ভোক্তা

  •    
  • ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:২৫

দেশে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ চিকন চাল খায়। বাকি সবাই হয় মোটা নতুবা মাঝারি মোটা চাল খেয়ে আসছে। সরকার প্রতি বছর যে চাল আমদানি করে, তার প্রায় পুরোটাই মোটা। অথচ ধান নিয়ে সরকারের সব পরিকল্পনা দখল করে রেখেছে চিকন চাল। কীভাবে এটা ঘটল, দেশে চালের ভোগের বাস্তবতা কী, এ নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা।

বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার বিরুদ্ধে হাতিয়ার মোটা চাল। দেশেও সরকারের দারিদ্র্যবান্ধব প্রায় সব কর্মসূচিই চলে মোটা চালে। অথচ ধান উৎপাদন পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া হয় চিকন চালকে। আর্থসামাজিক উন্নতি এবং ভোক্তার রুচিবোধের পরিবর্তন বোঝাতে মোটা চাল ছেড়ে চিকন চাল বেছে নেয়াকে মাপকাঠি করা হয়।

উৎপাদন ও বাজার পরিস্থিতিতে চিকন ও মোটা চালের বাস্তবতা কী, তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে এখনও ৩ কোটি ৯১ লাখ থেকে ৪ কোটি ৮ লাখ ভোক্তা মোটা চাল খাচ্ছে। ভোক্তার মোটা চাল খাওয়ার প্রবণতা গত ২০ বছরে মাত্র ১ শতাংশ ওঠানামা করেছে। সেটিও হয়েছে বছরওয়ারি ধান উৎপাদনের তারতম্যের কারণে।

হাউব্রিড ধান থেকে পাওয়া যায় মোটা চাল। এর অনেক জাত থাকলেও সব কটি উৎপাদনে নেই। মূলত হীরা-২, হীরা-৫, হীরা-১৯সহ স্থানীয় কয়েকটি জাত মোটা চালের বড় অংশ সরবরাহ করে।

এর বিপরীতে মোট জনগোষ্ঠীর ৯ কোটি ৫২ লাখ তার সাধ্য অনুযায়ী খাচ্ছে বিভিন্ন মানের ‘মাঝারি মোটা চাল’। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় ৫০ শতাংশ চালের জোগান দিচ্ছে উচ্চ ফলনশীল দুটি জাত ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯। বাকি অংশ মিলছে অন্যান্য হাইব্রিড ও উফশী জাত থেকে।

অন্যদিকে দেশে ১১ কোটি ৯০ লাখ ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি থাকলেও মাত্র ৩ কোটি ৪০ লাখ ভোক্তা খাচ্ছে চিকন চাল। অর্থাৎ দেশে অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে চিকন চালের ভোক্তা বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, তা চালের বাজারে প্রবেশ করা মিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কারসাজির কল্যাণে।

এদিকে যে পরিমাণ চিকন চাল খাওয়া হয়, তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পশুখাদ্য হিসেবে যে চাল ব্যবহার হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই মিলাররা মিলপর্যায়ে মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চালকে মিলিং ও ওভার পলিশিং করে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে বের করছেন। কিছু চাল এনিমেল ফিড ঘোষণা দিয়ে আমদানিও হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে মোটা চালের ভোক্তা কমেনি।

তার প্রমাণ মেলে গত পাঁচ বছরের ভোগের পরিসংখ্যানে।

মোটা চালের ভোক্তা বরং বাড়ছে

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, মোটা চাল খাওয়ার পরিমাণ নিছক কম নয়। গত পাঁচ বছরে মোট ৪ কোটি ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৩৬০ টন মোটা চাল খাওয়া হয় দেশে। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোটা চাল খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮১ লাখ ১২ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৭ লাখ ৬ হাজার ৯৬০ টন। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাওয়া হয় ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার টন। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৬ লাখ ৪ হাজার টন মোটা চাল খাওয়া হয়।

বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতে রয়েছে দেশ। গত দুই বছরে সামাজিক শ্রেণি কাঠামোয় করোনার যে আঘাত লেগেছে, তার নেতিবাচক প্রভাবে আগের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। এতে দিন দিন মোটা চালের ভোক্তা আরও বাড়ছে। বিষয়টি টের পেয়েছে সরকারও। তাই আগের অবস্থান থেকে বের হয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নীতিনির্ধারকরা এখন মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানোর রোডম্যাপের কথা বলছেন।

পরিকল্পনায় বদল আসছে

সরকারের উৎপাদন পরিকল্পনায় কেন মোটা চাল গুরুত্ব পাচ্ছে না, জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী দিনে অধিক উচ্চ ফলনশীল মোটা জাতের ধানের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর।’

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ পদক্ষেপের ভালো একটা ফলাফল আমরা আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে পাব।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন ও কৃষি বিজ্ঞানী ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস নিউজবাংলাকে মোটা চাল প্রসঙ্গে বলেন, ‘ময়মনসিংহে বিরুই চালের ব্যাপক উৎপাদন হয় এবং স্থানীয়রা এই চাল খায়; আবার সাপ্লাইও দেয়। এটা কিন্তু চিকন না। বরিশালে প্রচুর মোটা ধান হয় এবং লোকে মোটা চাল খায়। সারা দেশের গ্রামেগঞ্জে এখনও বেশির ভাগ মানুষ মোটা চালের ভাত খায়। যারা বলেন, রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না কিংবা গরুকে খাওয়ানো হয়, এগুলো অপ্রাসঙ্গিক ও বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা; অজ্ঞতাবশতও হতে পারে। এ ধরনের আলোচনা না টানাই ভালো।’

এসবে না গিয়ে তিনি যত দ্রুত সম্ভব অতি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত (হাইব্রিড) মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ধরে রাখার পরামর্শ দেন।

চাল চার ধরনের

দেশে বোরো, আমন ও আউস– এই তিন মৌসুমেই ধান উৎপাদন হয়, তবে সব মৌসুমের সব ফলনেই চাষ হয় উফশী এবং হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাত। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ২০১টি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের ছাড়পত্র রয়েছে, তবে কৃষক পর্যায়ে সারা দেশে ১০৮টি জাতের ধান কম-বেশি চাষ হয়। এগুলো থেকেই চাহিদা অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রার ধান উৎপাদন হয়।

এসব ধান থেকে সাধারণত চার প্রকার চাল পাওয়া যায়। সেগুলো হলো মোটা, মাঝারি মোটা, মাঝারি চিকন ও চিকন চাল। এর মধ্যে কোন ক্যাটাগরির চালের কত শতাংশ ভোক্তা রয়েছে, তা জানার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগ।

এ লক্ষ্যে সারা দেশে একটি জরিপ চালানো হয়। এই জরিপের সময় বিবেচনায় নেয়া হয় ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ২০ বছরকে। কোন বছর দেশে মোট কী পরিমাণ ধান-চাল উৎপাদন হয়েছে এবং ওই উৎপাদন থেকে কোন ক্যাটাগরির চাল কত শতাংশ মানুষ খেয়েছে, তা ছিল জরিপের বিষয়বস্তু।

২০২০ সালে এই জরিপটি শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে তা দেশে এখনও অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ জরিপটি সরকারের দায়িত্বশীল সব সংস্থার কাছে সংরক্ষিত।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে সেই অপ্রকাশিত জরিপের সারাংশ উঠে এসেছে।

ব্রি পরিচালিত এই জরিপে দাবি করা হয়, দেশে ১৭ কোটি মানুষ। বছরওয়ারি উৎপাদন বিবেচনায় মোটা চাল খায় জনগোষ্ঠীর ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চাল খায় ৫৬ শতাংশ মানুষ। আর ২০ শতাংশেরও কম মানুষ খাচ্ছে চিকন চাল। এ তথ্যের সূত্র ধরেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিভিন্ন রকম চালের উল্লিখিতসংখ্যক ভোক্তার সংশ্লিষ্টতা মিলেছে।

‘গুরুত্বহীন’ মোটা চালেও কেন সংকট

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হালনাগাদ জরিপ অনুযায়ী দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র। আয়সীমা ও ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় এই দুই শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীই মোটা চালের ভোক্তা, যাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।

দরিদ্ররাই মোটা চালের একমাত্র ভোক্তা নয়। পারিবারিক সমৃদ্ধি আছে গ্রামের এমন অনেক পরিবারও মোটা চালে অভ্যস্ত। কিছু পরিবার নিজেরাই খাওয়ার জন্য ধান উৎপাদন করে, যেগুলো স্থানীয় ও মোটা জাতের।

এভাবে প্রতি বছর উৎপাদিত চালের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাজারে যাওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে যায়। এসব কারণে মোটা চালের যত উৎপাদন হয়, তার সবটাই বাজারে পাওয়া যায় না। এর বাইরে ভোক্তাকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চিকন চাল খাওয়ানোর গোপন অপতৎরতা তো রয়েছেই।

এ কারণে সবখানে দোকানজুড়ে বস্তার খোলামুখে সাজানো থাকে বাড়তি দামের মাঝারি চিকন চাল কিংবা তার চেয়েও দামি চিকন চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল)। চিকন চালের দাম বেশি হওয়ায় এখন মোটা চালের দামও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম হলো কোনো পণ্যের সরবরাহ কম হলে এবং তার বিপরীতে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে। অর্থনীতির সেই চিরাচরিত প্রভাবই এখন বাজারে পড়ছে।

বাজারে এখন বছরজুড়ে মোটা চাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, মাঝারি মোটা ৪৬ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি চিকন ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ও চিকন (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা কেজির মধ্যে উঠানামা করছে, তবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত চালের দাম আরও বেশি।

এসব কারণে বর্তমান বাজার কাঠামো অনুযায়ী এ চাল কেনার রসদ জোগাতেও অনেকে দিনভর দিচ্ছে হাড়ভাঙা শ্রম। কেউ বা লজ্জা ভুলে মাসের হিসাবটা একটু সহজ করতে বিকল্প উপায় খুঁজছে। আরও একটু সস্তায় মোটা চাল পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সরকারের সুলভ মূল্যের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে।

মোটা চালের সরবরাহ সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশে চালের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে, তবে চাহিদা অনুযায়ী মোটা চাল কম। এতে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

‘দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা ২০ লাখ টন চাল আমদানির মাধ্যমে মজুত বাড়িয়েছি। বিভিন্ন কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণেই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।’

খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, ‘প্রতি বছরই সরকার (খাদ্য মন্ত্রণালয়) দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে বাফার মজুতের চেষ্টায় থাকে। স্থানীয় পর্যায় থেকেই তা সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। গত বোরো মৌসুমেও সরকার ১৯ লাখ ৮০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহের কর্মসূচি নিয়েছে।

‘এরই মধ্যে আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগ পূরণ করেছি। এর বাইরে বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমরা চাল আমদানিও করেছি। দেশে এখন চালের স্মরণকালের রেকর্ড মজুত রয়েছে।’

পশুখাদ্যের দাবি অনর্থক

জাতিসংঘ বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা নিরসনে মোটা চালের উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ধানের ফলন মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। ধান উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশও মোটা চালকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা ওই চাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করছে, কিন্তু বাংলাদেশের উন্নতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহ্‌মুদ মোটা চাল খাওয়া ও কুঁড়েঘরের ব্যবহার কমে যাওয়াকে নজির হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না; মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়।’

চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে উত্তর দিতে গিয়ে খোদ কৃষিমন্ত্রীও অনেক কারণের মধ্যে মোটা চালের কিছু অংশ এনিমেল ফিড হিসেবে ব্যবহারের তথ্য দেন, তবে উভয়ের মন্তব্যই অনর্থক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, “পশুখাদ্যের জন্য যে মোটা চালের কথা বলা হয়, তা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দিয়েই কিছু পরিমাণ লো কোয়ালিটির ‘এনিমেল ফিড’ হিসেবে আমদানি করে থাকেন। সেগুলো কখনও কখনও অনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় অন্যভাবে মার্কেটে চলেও আসতে পারে, যা ভোক্তাকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে বিক্রি করতে গিয়ে এ রকম প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে আমদানি করা লোয়ার কোয়ালিটির চালের বাইরেও ভালো মানের মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চালের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে এনিমেল ফিড তৈরি হচ্ছে।”

এত চিকন চাল আসে কোথা থেকে

কৃষিবিদ পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘বাজারে চিকন চালের যে ছড়াছড়ি, তার অর্ধেকও দেশে উৎপাদন হয় না। চিকন চালের ফলন রেকর্ডও খুব একটা ভালো না। তাহলে এর উৎস কোথায়? মূলত মাঝারি মোটা চালকেই মেশিনে কেটে চিকন করা হচ্ছে। আর যে অংশকে ছাঁটা হচ্ছে, তা দিয়ে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে রাইস ব্র্যানসহ বহুমুখী এনিমেল ফিড তৈরি হচ্ছে।’

এই কৃষিবিদের ভাষ্য, ‘চালে এই কাটাছেঁড়া বন্ধ করতে না পারলে একদিকে ভোক্তারা যেমন মারাত্মক পুষ্টি সংকটে পড়বে, অন্যদিকে চালের বাজারে নৈরাজ্যও বন্ধ হবে না। যতদূর জানি সরকার তা বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগও নিতে শুরু করেছে।’

ব্রির মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির বলেন, ‘ভোক্তারা যতক্ষণ না সচেতন হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভালো ফলাফল পাব না। কারণ ছেঁটে চিকন করার ফলে চালে যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা পুষ্টির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর আর অস্তিত্বই থাকে না। এসব ঝামেলা এড়াতে মোটা চাল খাওয়াটাই হচ্ছে ভোক্তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।’

দেশে চাল প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘দেশে এত এত চিকন চালের সবটা দেশে উৎপাদন হয় না। আবার মিনিকেট নামেও কোনো ধান নেই। তাহলে এত চিকন চাল আসে কোথা থেকে?’

তিনি বলেন, ‘আসলে নাজিরশাইল (নাজিরশাহী), জিরাশাইল, শম্পা কাটারি ছাড়াও ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯সহ বিভিন্ন মাঝারি চিকন হাইব্রিড জাতের ধানকে স্থানীয় পর্যায়ের মিলগুলোয় প্রসেস করে চিকন করা হয়। আর পলিশ করা অংশ দিয়ে বিভিন্ন বাইপ্রোডাক্ট তৈরি করা হয়।’

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম তালুকদার বলেন, ‘বাজার থেকে বেশি জনপ্রিয় আটটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, এ চালগুলোর সবই মোটা। বিভিন্ন ধরনের মেশিনে ব্লেন্ডিং করে কেটে-ছেঁটে পলিশ করা হয়েছে। ওই ফেলে দেয়া অংশ দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পশুখাদ্য।’

মিলারদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ মণ ধান থেকে ফ্রেশ মিনিকেট চাল পাওয়া যায় সাড়ে ছয় মণ। এ প্রক্রিয়ায় উচ্চমূল্যের হ্যাচারি ফিড পাওয়া যায় ১৫ কেজি, রাইসব্র্যান পাওয়া যায় ৫ থেকে ৬ কেজি। এ ছাড়া এগুলোর বাইরে পশুখাদ্য কালো চাল বা খুদ পাওয়া যায় ৭ থেকে ১০ কেজি; কুঁড়া হয় ৭০ থেকে ৮০ কেজি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক হাজার কেজি মোটা চাল প্রসেস করে চিকন চাল বা মিনিকেট চাল পাওয়া যায় সাধারণত ৯৩৩ কেজি। এ ছাড়াও সাদা খুদ ২৬.৫ কেজি, কালো খুদ ১৪ কেজি, মরা চাল ৪.৫ কেজি, ময়লা ০.৭৫ কেজি ও পলিশ ২৭ কেজি পাওয়া যায়।

বেশি জাত চিকন চালে

ধানের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনায় মোটা জাতের হাইব্রিড ধান চাষাবাদের চেয়ে মাঝারি চিকন ও চিকন হাইব্রিড ধান উৎপাদনই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ঠিক, ধান উৎপাদনে আমরা রেকর্ড গড়লেও মোটা জাতের হাইব্রিড ধান উৎপাদন সেভাবে বাড়াতে পারিনি। এটা বাড়াতে পারলে স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি খরচও বাঁচাতে পারি। মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।’

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির জানান, ‘বিষয়টি ঠিক। অনেকেই বলেন, মোটা চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে, আসলে তো মাঠপর্যায়ে মোটা চালের উৎপাদনই কম। আমাদের ‘৭৪’ ছাড়া ‘৪৯’ এর পরে ‘১০৮’ পর্যন্ত যে ভ্যারাইটিগুলো (জাত) আছে, তার বেশির ভাগই চিকন। এসব কারণে মোটা চালের পরিমাণ বাজারে কমে গেছে এবং মাঝারি চিকন ও চিকন চালের সরবরাহ বেড়ে গেছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোটা চালের অনেক ভ্যারাইটি আমাদের আছে। চাইলেই রিলিজ করতে পারি, কিন্তু মোটা চাল ক্রেতারা খুব একটা নিচ্ছে না।

‘আমরাও সার্বিক পরিস্থিতি অবজার্ভ করছি। যদি ভালো ভালো লাইনের ভ্যারাইটি রিলিজ করতে পারি, তাহলে এ চালের উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব।’

মাঝারি মোটা ও চিকন চালের ভোগের পরিমাণ

গত পাঁচ বছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে মাঝারি মোটা ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টন এবং চিকন চাল ছিল ৬৯ লাখ ৪২ হাজার টন।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন, যেখানে মাঝারি মোটা চালের ভোগ হয় ১ কোটি ৮৯ লাখ ২৮ হাজার টন। অন্যদিকে চিকন চালের ভোগ ছিল ৬৭ লাখ ৬০ হাজার টন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন উৎপাদন থেকে মাঝারি মোটা চাল খাওয়া হয় ২ কোটি ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৪০ টন। চিকন চাল খাওয়া হয় ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০০ টন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাঝারি মোটা চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন। চিকন চালের উৎপাদন ৭২ লাখ ৮০ হাজার টন। মোট চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন।

সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। সেখানে চিকন চাল খাওয়া হয় ৭১ লাখ ৭০ হাজার টন। অন্যদিকে মাঝারি মোটা চাল খাওয়া হয় ২ কোটি ৭৬ হাজার টন।

ক্যাটাগরি অনুযায়ী চালের পরিমাপ

মোটা, মাঝারি কিংবা চিকন চালের আকার পরিমাপ জটিল হলেও তা চোখে দেখলে সহজেই চেনা যায়, তবে মোটা বা মাঝারি ক্যাটাগরিতে ফেলতে হলে ধান থেকে খোসা ছাড়ানো অবস্থায় চালটি লম্বায় যতটুকু, তার তিন ভাগের পৌনে এক ভাগ হতে হবে চওড়া। চালটি সরু হলে তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত হবে ৩:৫:১।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, ৩ মিলিমিটার (এমএম) থেকে ৬ এমএম লম্বা সাইজের চাল মোটা বা মাঝারি মোটা শ্রেণিভুক্ত। ৬ এমএম থেকে এর বেশি লম্বা হলে ওই চালটি চিকন বা সরু হয়। অন্যদিকে ৬.৫ এমএম থেকে ৭ এমএম বা তার চেয়ে বেশি লম্বা ও সুগন্ধিযুক্ত হলে সেটা ‘সরু ও অ্যারোমেটিক’ শ্রেণিভুক্ত।

লম্বায় ৩ এমএম ও সুগন্ধি হলে সেটাকে শুধু অ্যারোমেটিক শ্রেণিভুক্ত বলা হয়। যেমন: চিনিগুঁড়া, কালিজিরা বা এ জাতীয় অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত চাল। এ ছাড়া কিছু জাতের চাল আছে, যা ৬ এমএম লম্বা। পার্শ্ব মাপ ২ এমএমের ঊর্ধ্বে হলে সেগুলোকে মোটা বা মাঝারি মোটা বা মাঝারি চিকন শ্রেণিভুক্ত হয়।

সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা

খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের তাগিদ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং মানুষ চিকন চাল খেতে পছন্দ করে, এটা মিথ্যা নয়। আবার এসডিজির লক্ষ্য হচ্ছে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়। এ বাস্তবতাও পরিকল্পনায় থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে করোনাজনিত সার্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতি, কর্মহীনতা এবং ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় মোটা চালের গুরুত্বকেও অস্বীকারের উপায় নেই। তা ছাড়া মোটা চালের ভোগ মানুষ কিংবা গরু যেই করুক, তা কিন্তু অন্য খাতেও ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ মোটা চালের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই প্রায় প্রতি বছর যে চাল আমদানি করা হচ্ছে, তার প্রায় সবই মোটা চাল।

‘যদি দেশেই মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে সরকারকে আমদানি করতে হবে না। সেদিকে গুরুত্ব দিয়েই আগাম পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ জীবনধারণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ধান-চালের উৎপাদনে স্বনির্ভরতা এবং তা বাজার পর্যায়ে সুষ্ঠু সরবরাহের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখাও জরুরি।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার বা সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ যদি মোটা চালকে গুরুত্ব না দেয়, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাস্তবতা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যে পণ্যের চাহিদা থাকে, সে পণ্যের উৎপাদন বা আমদানি বেশি হয়। দেশে মোটা চালের উৎপাদন তো হচ্ছে। আবার দেখছি আমদানিও হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে মোটা চাল গুরুত্ব হারায়নি।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের কাজ হলো জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে লক্ষ্যমাত্রার উৎপাদন এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা। সেটি যদি ধান হয়, তাহলে সরকারকে সেভাবেই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।’

কৃষি বিজ্ঞানী ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জোরদারের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া প্রান্তিক, অতি দরিদ্র ও দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক ধরে রাখাও সম্ভব নয়।’

এ বিভাগের আরো খবর