কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চললেও নতুন কমিশন কবে দায়িত্ব নেবে, সে বিষয়টি পুরোপুরি অনিশ্চিত। সোমবার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কমিশন শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
কমিশনে এই শূন্য অবস্থা খানিকটা অস্বাভাবিক ঠেকলেও নির্বাচন কমিশনের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নিলে এটি একেবারে বিরল নয়। এখন পর্যন্ত যে ১২টি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি গঠন হয়েছে আগের কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পড়ে।
বিদায়ের ক্ষণ গুনতে থাকা কে এম নুরুল হুদাও সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন আগের সিইসি রকিবউদ্দীন আহমদের দায়িত্ব ছাড়ার ৬ দিন পর। এর আগে এম এ সাঈদ ও এ টি এম শামসুল হুদাও আগের সিইসির মেয়াদ শেষের কিছুদিন পরে দায়িত্ব নেন।
নির্বাচন কমিশনের সব পদই সাংবিধানিক, তবে মেয়াদ শেষের পরও ফাঁকা থাকায় সাংবিধানিক সংকট বা শূন্যতা তৈরি হয় না বলে জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা।
ব্যাখ্যায় তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব নির্বাচন পরিচালনা করা। এই সময়ে কোনো নির্বাচনের সূচি নেই। নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন সব নির্ধারিত ভোট শেষ করে গেছে। ফলে নতুন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণে কয়েকটি দিন দেরি হলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এ সময়ে কমিশনের নিয়মিত কাজগুলো করে যাবে কমিশন সচিবালয়।
কে এম নুরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস বাকি থাকতে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি। এ সময়ের মধ্যেও নতুন কমিশন গঠন করতে না পারার একটি কারণ সংলাপে বেশির ভাগ দলের প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন।
জাতীয় সংসদে এই আইন করার পর তার আলোকে নতুন কমিশন গঠনে করা হয়েছে সার্চ কমিটি। এ কমিটি কমিশনার হিসেবে নাম চাওয়ার পর তিন শতাধিক জনের নামের প্রস্তাব জমা পড়েছে। এখন সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের কর্মকৌশল ঠিক করছে।
এই সার্চ কমিটি কাজ শেষ করতে সময় পাচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যে তারা ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দিতে চাইছে। তারপর সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
অর্থাৎ এবার অন্তত দুই সপ্তাহের মতো ফাঁকা থাকতে পারে নির্বাচন কমিশন।
এর আগে তিনবার কমিশন ফাঁকা থাকার যে ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ দিন কেউ পদে ছিলেন না ২০০০ সালে।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০০ সালের ৮ মে সিইসি হিসেবে মোহাম্মদ আবু হেনা দায়িত্ব ছাড়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন এম এ সাইদ। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওই বছরের ২৩ মে। মাঝে সিইসির পদ শূন্য ছিল ১৫ দিন।
২০০৬ সালের শেষে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিলেও ভোট করতে পারেনি। এক দফা পিছিয়ে ভোটের তারিখ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
এর ১১ দিন আগে ১১ জানুয়ারি জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দায়িত্ব নেয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
এ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হলে আগের কমিশনের সবাই একে একে দায়িত্ব ছাড়েন।
২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি সিইসি পদ থেকে সরে দাঁড়ান বিচারপতি এম এ আজিজ। জ্যেষ্ঠতার বিচারে নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান আসেন ভারপ্রাপ্ত সিইসির দায়িত্বে, তবে ৩১ জানুয়ারি এম এ আজিজের পথ ধরেন কমিশনের অপর ৫ সদস্য।
৪ দিন কমিশন শূন্য থাকার পর ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সিইসির দায়িত্ব পান এ টি এম শামসুল হুদা। তিনি নির্বাচন কমিশনার পদে সঙ্গী হিসেবে পান ছহুল হোসাইনকে, তবে ওই কমিশনের অপর সদস্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন যোগ দেন ১৪ ফেব্রুয়ারি। দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে ঠিক ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন তাদের প্রত্যেকেই।
এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব গ্রহণ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রথমবার গঠন করা হয় নির্বাচন কমিশন। ২০১২ থেকে ২০১৭ মেয়াদকাল শেষে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশনের ৪ জন বিদায় নেন ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। অপর এক সদস্যের মেয়াদ শেষ হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি।
২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের কমিশনারদের নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। পুরো কমিশন এক দিনেই দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর মধ্যে সিইসি হিসেবে রকিবউদ্দীনের বিদায়ের ৬ দিন পর যোগ দেন নুরুল হুদা।
সংকট নেই
কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নতুন কমিশন চূড়ান্ত না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি একটা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়, কিন্তু কমিশন না থাকায় সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না, তখন ভ্যাকুয়াম হবে। আর নরমালি কমিশনের যে সিদ্ধান্তগুলো আছে, সেগুলোর জন্য তো কমিশন সেক্রেটারিয়েট আছে। ধরা যাক, মার্চের ১ তারিখ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া আছে। তাহলে সেটা কমিশন সচিবালয় করে ফেলবে।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সংবিধানে কিংবা আইনে এ ধরনের শূন্যতার কথা নাই। সোমবার বর্তমান কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে একটু বিলম্ব হলেও আইনে শূন্যতা হিসেবে গণ্য হবে না।’
নতুন কমিশন নিয়োগ দেয়ার আগে বর্তমান কমিশনের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সম্ভব কি না, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, তারা সেটা পারবেন না। কারণ সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, তারা পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করবেন। পাঁচ বছর শেষ হয়ে গেলে এমন কথা নাই যারা স্থলাভিষিক্ত হবেন, তারা না আসা পর্যন্ত কারা দায়িত্বে থাকবেন।’
এই সময়ে ‘ইলেকশন কমিশন বন্ধ হয়ে যাবে না’ বলেও জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সচিবালয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ দায়িত্ব পালন করবে। নতুন নির্বাচন কমিশন এলেই কোনো নির্বাচনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে।’
সিইসি পদে ছিলেন যারা
স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১২ জন। আর নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন ২৭ জন।
৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি মো. ইদ্রিস।
৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম।
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসুদ।
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি আব্দুর রউফ।
২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬ পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক।
৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবু হেনা।
২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এম এ সাইদ।
২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি এম এ আজিজ।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এ টি এম শামসুল হুদা।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কে এম নুরুল হুদা।