বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চট্টগ্রামে নালা-খাল এখনও মৃত্যুফাঁদ

  •    
  • ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৪০

এত এত মৃত্যুর পরেও নিরাপদ হয়নি চট্টগ্রাম নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ নালা ও খালের পাড়। বদলায়নি পুরনো চিত্র। কেবল কাগজে-কলমে ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ আর বাঁশ-দড়ি দিয়ে বেষ্টনী দিয়ে দায় সেরেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কোথাও কোথাও সেই বাঁশ আর দড়িও নেই। উন্মুক্ত এ সব খাল ও নালার পাশ দিয়ে যেন মৃত্যু হাতে নিয়ে চলাচল করছে মানুষজন, যেখানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

৬০ লাখ জনবসতির চট্টগ্রাম নগরে মোট খালের সংখ্যা ৫৭টি, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৬৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৩৬টি খাল ও ৩০২ কিলোমিটার নালা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) আওতায় বাকি ২১টি খাল ও ৬৪৮ কিলোমিটার নালা।

গত ৬ বছরে এ সব উন্মুক্ত নালা ও খালে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এর মধ্যে দুইজনের খোঁজই মেলেনি।

কেবল ২০২১ সালেই মারা গেছেন ৪ জন। যাদের মধ্যে আগ্রাবাদে নালায় পড়ে গত বছরের ২৭ সেপ্টম্বরে প্রাণ হারান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। তার আগে খালে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ৩ জনের। এর মধ্যে ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় পা পিছলে নালায় তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। পরে তার লাশটিও পাওয়া যায়নি।

একই বছরের ৩০ জুন মেয়র গলির চশলা খালে পড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হয় এক পথশিশু। গত ৬ ডিসেম্বর চশমা খালে বোতল কুড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয় পথশিশু কামাল উদ্দিন।

এত এত মৃত্যুর পরেও নিরাপদ হয়নি চট্টগ্রাম নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ নালা ও খালের পাড়। বদলায়নি পুরনো চিত্র। কেবল কাগজে-কলমে ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ আর বাঁশ-দড়ি দিয়ে বেষ্টনী দিয়ে দায় সেরেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কোথাও কোথাও সেই বাঁশ আর দড়িও নেই। উন্মুক্ত এ সব খাল ও নালার পাশ দিয়ে যেন মৃত্যু হাতে নিয়ে চলাচল করছে মানুষজন, যেখানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

গত বছর খালে ও নালায় পড়ে কয়েকজনের মৃত্যুর পর উন্মুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ নালা-নর্দমা, ফুটপাত ও খালের তালিকা করতে তৎপর হয় সিটি করপোরেশন। চিহ্নিত করা হয় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকার ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৯ কিলোমিটার। তালিকা করলেও এ সব স্থান নিরাপদ করার কাজ চলছে ঢিমেতালে।

চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখনো প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ বাকি। যদিও বলা হয়েছিল, জানুয়ারিতেই শেষ হবে এ কাজ।

এ দিকে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে শুনিয়েছেন আশার বাণী, বলছেন দ্রুতই শেষ হবে কাজ। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাজ খুব বেশি বাকি নেই। বর্ষার আগেই নালা ও খালের পাড় নিরাপদ হবে।’

বদলায়নি চিত্র

নগরীর খালে ও নালার মৃত্যুফাঁদে পড়ে মৃত্যুর মিছিল বাড়লেও, বলদায়নি পুরনো চিত্র। চসিকের প্রধান প্রকৌশলীর কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি মাঠ পর্যায়ে। অধিকাংশ স্থানে গিয়ে দেখা গেছে বাঁশ, কাঠ কিংবা দড়ি দিয়ে ঘেরাও দিয়েই খাল ও নালা নিরাপদ করার কাজ সেরেছে চসিক।

গত ৬ ডিসেম্বর যে স্থানে বোতল কুড়াতে গিয়ে তলিয়ে যায় পথ শিশু কামাল, বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তা এখনো অরক্ষিত হয়েই পড়ে আছে। খালের পাড়ে জটলা পাকিয়ে আছে একদল পথশিশু। তাদের মধ্যে ১৩ বছর বয়সী রহমত বলে, ‘ডর করে খালে নামতে। হের ফরেও ট্যাকার লাইগ্যা নামতে হয়। কিচ্ছু করার নাই।’

একই চিত্র নগরীর মহেশখাল, হিজড়া খাল, মির্জা খাল, বির্জা খাল সংলগ্ন পাড়গুলোর। এ সব খালের পাড় এখনো উন্মুক্ত। নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী। হালিশহর বড়পুল কাঁচাবাজারের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে মহেশখাল। বাজার সংলগ্ন খালের পূর্ব পাড়ে সম্প্রতি সড়ক নির্মাণ করেছে চসিক। কিন্তু নেই কোনো নিরাপত্তা দেয়াল।

এ সড়ক ধরে প্রতিদিন যাতায়াত করে শত শত মানুষ। কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত খালটি। স্থানীয়রা বলছেন, খালে পড়ে যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে যে কেউ। শিশুদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। পাশে বস্তি থাকায়, বস্তির শিশুরা খালপাড়ে খেলাধুলা করে।

চকবাজারের কাপাসগোলা এলাকায় হারেছ শাহ লেন ধরে কিছু দূর এগুলেই চাক্তাই খাল। খালের দুই পাশে নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী। শীতকালেও সমান্তরাল সড়ক আর খালের পানির উচ্চতা। খাল পাড়ের সরু রাস্তা চলে গেছে চাক্তাইয়ের দিকে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শিশু ও নারী-পুরুষের ব্যস্ত চলাচল এই পথে। পা ফসকে খালে পড়লে তলিয়ে যাবেন নিমিষেই।

স্থানীয়রা জানান, বৃষ্টি হলেই খাল ও দুই পাশের রাস্তা একাকার হয়ে যায়। আলাদাভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকে না। স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানি আবদুস সোবহান নিউজবাংলাকে বলেন,‘জোয়ার আর বৃষ্টির সময় পানিতে রাস্তা আর খাল সমান হয়ে যায়। স্রোতও থাকে তীব্র। কখন কে ভেসে যায়, তা নিয়ে শঙ্কায় থাকি।’

এ দিকে নগরের ষোলশহর থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত চলছে নালার পাশে সিডিএ’র প্রতিরোধ দেয়ালের নির্মাণকাজ। সেখানে প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে নামমাত্র অস্থায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনি দেয়া হচ্ছে। মুরাদপুরে গত বছর যে স্থানে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ, সেখানে দেখে মেলে বাঁশের তৈরি অস্থায়ী বেষ্টনি।

সম্প্রতি এই নিরাপত্তাবেষ্টনীর একপাশের বাঁশ ভেঙে নালায় পড়ে গেছে। এর পাশ দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে নিত্য যাতায়াত করছেন পথচারীরা। আগ্রাবাদে যে স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে, একমাত্র সেখানেই চসিকের স্থায়ীভাবে নির্মিত নিরাপত্তা দেয়াল দেখা গেছে।

তদন্তে গরজ নেই, বাস্তবায়ন হয়নি সুপারিশও

চট্টগ্রাম নগরীর উন্মুক্ত খাল ও নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কোনো সংস্থাই তদন্ত করেনি। বরং একে অপরকে দোষারোপে দায় এড়ানোর চেষ্টা চলে। তবে তদন্তে দুই সংস্থার গরজ না থাকলেও, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের তদন্তে দায়ী করা হয়েছে তাদের। যদিও তদন্ত প্রতিবেদনে করা হয়নি কোনো সুপারিশ। তবে সে সময় দুর্ঘটনারোধে ৯টি সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ।

সুপারিশে বলা হয়, উন্মুক্ত খাল ও নালার পাশে প্রতিরোধ দেয়াল দিতে হবে। নির্মাণাধীন প্রকল্পে টিন দিয়ে ঘেরাও করে নিরাপত্তাবেষ্টনী নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ফুটপাতে যেসব নালার উপর স্ল্যাব নেই সেখানে স্ল্যাব বসাতে হবে। দুর্ঘটনার পর কিছু কিছু স্থানে নালায় স্ল্যাব বসালেও বাকি সুপারিশগুলোর মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন নেই। নগরবাসী নিরাপদ চলাচলে স্থায়ী সমাধানে না হেঁটে বাঁশ আর দড়িতেই আস্থা রেখেছে এই দুই সেবা সংস্থা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো ফারুক হোসেন সিকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে দুই সংস্থাকে কিছু সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি সেভাবে আমাদের চোখে পড়েনি। উন্মুক্ত খাল ও নালা নিরাপদ করতে আমরা কিছু স্থায়ী সমাধানের সুপারিশ করেছিলাম।

বাঁশ আর দঁড়ি দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত কোনক্রমেই বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বরং এগুলো আরো বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে।’

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নগরের ঝুঁকিপূর্ণ নালা-ফুটপাত চিহ্নিত করে নিরাপদ করার কাজ চলছে। যেখানে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছে, সেখানে সিডিএ অস্থায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দিচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা নগরীর খাল ও নালার পাড় নিরাপদ করতে কাজ করছি। আশা করছি দ্রুতই এ কাজ শেষ হবে।’

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘প্রকল্পের কাজের সময় নিরাপত্তাবেষ্টনী দেয়া থাকে। অনেক জায়গায় তা নষ্ট বা চুরি হয়ে যায়। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নিরাপদে চলাচল করতে পারবে নগরবাসী।’

এ দিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নাগরিকের মৃত্যুর পরেও এই দুই সেবা সংস্থার বোধোদয় হয়নি। যেখানে নাগরিকদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের বিধান, সেখানে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। না আছে দায়বোধ, না আছে কোনো আন্তরিকতা।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘তাদের কাছে পিঁপড়ার চেয়েও নাগরিকদের জীবন মূল্যহীন। স্থায়ী সমাধানে না গিয়ে বাঁশ আর লাল-সাদা দঁড়িতে দায়িত্ব শেষ করতে চাইছে তারা। তাদের এমন অবহেলার খেসারত আগামী বর্ষায় নগরবাসীকে দিতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর