বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পান থেকে চুন খসলেই ‘একঘরে’

  •    
  • ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:২৪

মোজাফফর বলেন, ‘এই যুগেও এমন শাস্তি দেখতে হবে, এ কেমন কথা। ঠিক আছে, সমাজে আসতে হলে যদি আবার আলুঘাঁটি খাওয়ানো লাগে খাওয়াব। কিন্তু এভাবে পাড়ার মধ্যে থেকে অপরিচিত মানুষ হয়ে থাকতে ভালো লাগে না।’

দুটি গ্রামের শখানেক পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন আগে গড়ে উঠেছে ‘সমাজ’। ঈদ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ যেকোনো ‘সামাজিক’ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে সেই ‘সমাজ’ থেকে। ‘সমাজের’ নীতি বিরুদ্ধ কিছু হলেই দেয়া হয় শাস্তি।

অভিযোগ উঠেছে, ‘সমাজের’ মনঃপূত না হওয়ায় এমন শাস্তি ভোগ করছে দুই পাড়ার তিনটি পরিবার।

পরিবারগুলোকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, গ্রামের কোনো অনুষ্ঠানে অভিযুক্তরা যেতে পারবেন না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে গ্রামের অন্যরাও আসতে পারবেন না।

এমনকি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করা হয়েছে অন্যদের। এক কথায় তাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। এভাবে তিন পরিবার একঘরে হয়ে আছে গত এক বছর ধরে।

এমন ঘটনা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের স্টেশনপাড়া ও স্কুলপাড়ায়। একঘরে করা তিনটি পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা হলেন ফেরদৌস আলী, মোজাফফর আলী ও আব্দুস সামাদ খন্দকার। এর মধ্যে মোজাফফরের বাড়ি স্কুলপাড়ায়। বাকি দুজন স্টেশনপাড়ার বাসিন্দা।

ভুক্তভোগীরা জানান, পান থেকে চুন খসলেই গ্রামের লোকদের একঘরে করার নির্দেশ দেয় ‘সমাজ’। এভাবে শুধু তিন পরিবার নয়, বিগত সময়ে আরও অনেককে এই শাস্তি পেতে হয়েছে।

গ্রামের কথিত ওই ‘সমাজ’ নিয়ন্ত্রণ করেন আবু নঈম সরকার লিংকন। তিনি স্থানীয় লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এর আগে তার বাবা আবু তায়েব সরকার তহির একইভাবে মাতব্বরের দায়িত্ব পালন করতেন।

আবু তায়েব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা। এ ছাড়া তারা পারিবারিকভাবে ছাতিয়ানগ্রামে প্রভাবশালী। গ্রামের স্কুল, মসজিদ ও কবরস্থানে তাদের জমি দান করা আছে। ফলে গ্রামে প্রভাবও খুব বেশি।

এভাবে তুচ্ছ কারণে দুই গ্রামের তিন পরিবারকে একঘরে করার বিষয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি আদমদীঘি উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে পরিবারগুলো।

ভুক্তভোগীদের একজন মোজাফফর আলী পেশায় হোটেল ব্যবসায়ী। তিনি স্কুলপাড়ায় থাকেন। ছাতিয়ানগ্রাম বাজারে তার ভাতের হোটেল রয়েছে। তিনি গত বছর কোরবানির ঈদের সময় থেকে একঘরে হয়েছেন।

মোজাফফরের ‘অপরাধ’ ছিল, মাতব্বর লিংকনের সঙ্গে ভাগে কোরবানি দিয়েছিলেন গত বছর, সেখান থেকে ‘সমাজের’ অংশ দিতে দেরি করেছেন। সে অপরাধেই তার পরিবারকে করে দেয়া হয়েছে একঘরে।

মোজাফফর জানান, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার পরিবারকে একঘরে রাখা হয়েছিল। সে সময় লিংকনের বাবা তাদের একঘরে করার ঘোষণা দেন। পরে জরিমানা হিসেবে গ্রামের সবাইকে আলুঘাঁটি করে খাইয়ে আবার ‘সমাজে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘এই যুগেও এমন শাস্তি দেখতে হবে, এ কেমন কথা। ঠিক আছে, সমাজে আসতে হলে যদি আবার আলুঘাঁটি খাওয়ানো লাগে খাওয়াব। কিন্তু এভাবে পাড়ার মধ্যে থেকে অপরিচিত মানুষ হয়ে থাকতে ভালো লাগে না।’

আরেক ভুক্তভোগী ফেরদৌস আলী স্টেশনপাড়ার বাসিন্দা। পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। তাকে গত বছরের জুলাইয়ে কোরবানির ঈদের পরে একঘরে করার সিদ্ধান্ত দেয় ‘সমাজ’।

ফেরদৌস বলেন, ‘গত ঈদুল আজহায় আমার বাড়িতে পশু কোরবানি দিই। কিন্তু আমাদের গ্রামের সবার কোরবানি আবু নইম লিংকনদের বাড়ির উঠানে দেয়ার নিয়ম করা হয়েছে। তাদের বাড়ির উঠানে কোরবানি না দেয়ায় লিংকন ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে সমাজচুত্য করার ঘোষণা দেন। কোরবানির পশুর মাংসের একটা অংশ ‘সমাজে’ পাঠানো হলেও তারা সেটি গ্রহণ করেননি।’

তিনি জানান, এই এক বছরে সামাজিক কোনো আয়োজনে তাদের থাকতে দেয়া হয়নি। অন্যদের আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

ফেরদৌস বলেন, ‘লিংকন আমার মামাতো ভাই, কিন্তু ওরা সবাইকে নিজেদের মতো শাসন করতে চান। পান থেকে চুন খসলেই তারা একঘরে ঘোষণা করেন।’

ফেরদৌসের প্রতিবেশী শিক্ষার্থী রেজাউল হক বলেন, ‘কয়েক দিন পরে আমার ভাইয়ের বিয়ে। সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছি, কিন্তু বাড়ির পাশের লোককে দাওয়াত দিতে পারিনি এখনও। এ বিষয়ে লিংকন কাকাকে অনুরোধ করেছি। তিনি জানিয়েছেন, দাওয়াত দিলে দিতে পারো, তাদের (ফেরদৌস) দাওয়াত দিলে আমরা কেউ যাব না।’

স্টেশনপাড়ার আরেক ভুক্তভোগী আব্দুস সামাদ খন্দকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। তাকে ‘সমাজচ্যুত’ করা হয় গত বছরের রমজান মাসে। কারণ ছিল ফিতরার টাকা ‘সমাজে’ জমা দিতে পারেননি।

বাড়িতে না থাকায় আব্দুস সামাদের সঙ্গে কথা হয়নি। তার ছেলে রুহুল আমিন একঘরে করার বিষয়টি জানান।

তিনি বলেন, ‘রমজান মাস থেকে একঘরে ঘোষণা করা হয়েছে। বাবার সঙ্গে পাড়ার অন্যদের কথা বলতে বা যোগাযোগ করতে নিষেধ করা আছে। আমি আলাদা থাকায় আমাকে এই নিষেধের আওতায় রাখেননি মাতব্বররা।’

গ্রামবাসী জানায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক শিক্ষকের বাড়ির একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বৈঠক বসে। বৈঠকে ওই তিন পরিবারকে দাওয়াত না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান ‘সমাজ’ নিয়ন্ত্রকরা। কিন্তু অনুষ্ঠানে আগেই ওই তিন পরিবারকে দাওয়াত দেয়া হয়। এ ঘটনা থেকে একঘরে হওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠে।

স্কুলপাড়ার এক বাসিন্দা বেলাল হোসেন জানান, লিংকনের দাদার আমল থেকে পুরো পাড়া তারা শাসন করে আসছে। দাদার পর তার এক বড় চাচা, চাচা মারা যাওয়ার পর লিংকনের বাবা, পরে বাবা অসুস্থ হওয়ায় লিংকন এখন মাতব্বর।

২ ফেব্রুয়ারি বসা ওই বৈঠকে একঘরে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে মাতব্বরদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে বলেও জানান বেলাল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সময়ে এলাকার আরও অনেকে এমন ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে ‘সমাজচ্যুত’ করা হয়। এই ভোগান্তির মধ্যে লিংকনের নিজের ফুফু শরিফুন রয়েছেন। তিনি স্কুলপাড়ার মোজাফফরের পাশের বাড়ির বাসিন্দা। শরিফুর জানান, কয়েক বছর আগে তাদের ‘সমাজচ্যুত’ করা হয়েছিল। পরে তা মিটে গেছে।

প্রায় ১০ বছর আগে ফেরদৌসের পাশের বাড়ির আরেক বাসিন্দা দুলাল মিয়াকে এমন একঘরে করা হয়েছিল। ওই সময় দুলালের বাবা রহিম উদ্দিন মারা গেলেও পাড়ার কবরস্থানে দাফন করতে দেননি মাতব্বররা। পরে আক্কেলপুরে তাকে দাফন করেন দুলাল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের অন্তত ৫ জন বাসিন্দা জানান, সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে জরিমানা দিতে হয়। জরিমানা হিসেবে আলুঘাঁটি বা অন্য কোনো আয়োজন করে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ানো লাগে।

‘সমাজের’ মাতব্বর থাকার বিষয়টি স্বীকার করে আবু নঈম সরকার লিংকন বলেন, ‘আমার দাদা জীবিত থাকতে এ গ্রামে সবকিছু দেখভাল করতেন। পরে বংশের অন্যরা এই দায়িত্ব পান।’

বিভিন্ন পরিবারকে একঘরে করার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এসব পুরোটাই ষড়যন্ত্র। বরং সমাজের নিয়ম না মানার অজুহাতে ওরা নিজে থেকে আলাদা হয়ে গেছে। তাদের আমরা বাড়িতে বন্দি করিনি। তারা সব জায়গায় যাচ্ছে, ব্যবসা করছে।’

লিংকন আরও বলেন, ‘সমাজে থাকতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হবে, এটা তারা মানতে চান না। এ জন্য নিজেরাই সমাজ থেকে বের হয়ে গেছে।’

তিন পরিবারের লিখিত অভিযোগ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শ্রাবণী রায় বলেন, ‘সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

জানতে চাইলে সমাজসেবা কর্মকর্তা ইসরাত জাহান জেনি বলেন, ‘ছাতিয়ানগ্রামে তিন পরিবারকে একঘরে করার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। বর্তমান সময়ে এমন ঘটনা খুবই অদ্ভুত। আগামী সোমবার থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর