কড়া নাড়ছে বসন্ত। তার পিছু পিছু আসছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। অথচ প্রেমের দারুণ অনুষঙ্গ গোলাপের দেখা নেই গোলাপগ্রামে।
বিশেষ এই দিনটিকে ঘিরে ফুলের বাজারে গোলাপের চাহিদা বরাবরই থাকে তুঙ্গে। চাহিদার কথা ভেবেই বছরের এই সময়টির আশায় বুক বেঁধে থাকেন সাভারের গোলাপ চাষিরাও।
কিন্তু এবার বিধি বাম। ‘ভালোবাসা দিবস’ যখন আর মাত্র দুদিন দূরে, তখন গোলাপ গ্রামখ্যাত বিরুলিয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলোয় গিয়ে দেখা গেছে গোলাপশূন্য সব বাগান। গোলাপ নেই বলেই এসব বাগানে এখন শুধুই হাহাকার।
বলা হচ্ছে, অসময়ে বৃষ্টিপাত ও কুয়াচ্ছন্ন শীতের আবহই এবার গোলাপ চাষিদের হাসি কেড়ে নিয়েছে। অজানা রোগে শুকিয়ে যাচ্ছে ফুলের কুঁড়ি, কচি ডালপালাসহ ফুলের কলিও। কিছু ফুল ফুটলেও সেগুলো রূপ ধরে রাখতে পারছে না বেশিক্ষণ। ধীরে ধীরে পচে কালো হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।
চাষিরা বলছেন, ইউনিয়নের শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগ্নীবাড়ি, কালিয়াকৈরসহ সবগুলো গ্রামেই এবার গোলাপের দেখা নেই।
ভরা মৌসুমেও গোলাপ নেই বাগানজুড়েএর আগে ২০১৭ সালে মড়ক লেগে তাদের বাগানের সব ফুল ও গাছ মরে গিয়েছিল। এ বছর গাছ মারা না গেলেও বাগান থেকে ফুল পাচ্ছেন না চাষিরা।
উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকেও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন চাষিরা। ফলে ফুলের এই ভরা মৌসুমে চরম আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
শ্যামপুর গ্রামের অভিজ্ঞ ফুলচাষি মনির হোসেন। প্রতি বছরের মতো এবারও ৬০ শতাংশ জমিতে ঋণ নিয়ে গোলাপের চাষ করেছেন। কিন্তু তার কোনো বাগানেই এবার ফুল ফোটেনি। এক মাস ধরেই দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাকে।
নিউজবাংলাকে মনির বলেন, ‘২০১৭ সালেও একবার এমন হইছিল। এলাকার সবার বাগানে অজানা রোগে গাছ আর ফুল মইরা শুকায় গেছিল। তখন সবাই দিশাহারায় ফালাইছিলাম। আমার বাগানেও অনেক গাছ নষ্ট হইয়া মইরা গেছিল।
‘ওই ঘটনার পর ঋণ কইরা আবার বাগান দাগ করাইছি। এই বছর আবার ওই রকম রোগ দেখা দিছে বাগানে। গাছের কচি ডাল, কুঁড়ি, কলি পচে শুকায় যাইতেছে। কোনো কিছুই বুঝবার পাইতেছি না। জমিতে পটাশ সার, নিড়ানি দিতাছি। কিন্তু বাগান থাইকা কোনো ফুল বেচতে পারতাছি না।’
মনির জানান, প্রতি বছর এই মৌসুমে একেকটা বাগান থেকে গড়ে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার গোলাপ সংগ্রহ করেন তিনি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি খুবই ব্যতিক্রম। গড়ে প্রতিদিন ১০০টি ফুলও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ঋণের টাকা পরিশোধ করার দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
একই এলাকার গোলাপ চাষি মালু মিয়ার ১৫০ শতাংশ জমিরও করুণ দশা। বাগানে ফুল না থাকায় দিশেহারা এই চাষি জানান, উপজেলা কৃষি অফিসের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে তারা নিজেরা মিলেই বাগান বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
মালু বলেন, ‘কোনো কর্মকর্তাই আমাদের বাগান পরিদর্শনে আসেননি এখনও। কিছুদিন আগে পাশের গ্রামে শুধু একটা মিটিং হয়েছিল শুনেছি। কিন্তু আমিসহ অনেক বড় ফুলচাষিরাই তার কিছু জানে না।’
বাগ্নিবাড়ী গ্রামের আম্বর আলীর ৭০ শতাংশ জমির বাগানেও দেখা যায়নি গোলাপ। একই চিত্র মোস্তাপাড়ার সিরাজ উদ্দিনের ৬০ শতাংশ ও শুক্কুর আলীর ৭০ শতাংশ জায়গায় গড়ে তোলা বাগানেও।
গোলাপ ফোটেনি তাই দুশ্চিন্তায় চাষিরাএদিকে বাগানে ফুল না থাকার প্রভাব পড়েছে সাভারের স্থানীয় ফুলের দোকানগুলোয়। ভালোবাসা দিবসের দুই দিন আগে থেকেই তাদের ২০-৩০ টাকা দরে যশোর থেকে গোলাপ কিনতে হচ্ছে। এত দামে গোলাপ কিনে আরও লাভে বিক্রি করা যাবে কি না তা নিয়ে বেশ শঙ্কাও আছে।
নবীনগর এলাকার ফুল ব্যবসায়ী ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘সাভার ও যশোর থেকে আমাদের এখানে গোলাপ ফুল আসত। কিন্তু সাভারের বাগান থেকে অনেক দিন ফুল সে রকমভাবে আসছে না। এ কারণে চাহিদা বেশি থাকায় যশোর থেকে আসা ফুলের বাজার চড়া। ২০-৩০ টাকা দরে প্রতিটি ফুল আমাদের কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিবসে এই দামে কেনা ফুল বেশি লাভে বিক্রি করা যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে।’
সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গোলাপ বাগানগুলোর বয়স অনেক। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাগানও আছে। প্রতি বছর অতিরিক্ত মাত্রায় সার প্রয়োগের কারণে মাটিতে পিএইচের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে গাছ মাটি থেকে আর খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না।’
এ ছাড়া অসময়ের বৃষ্টি, কুয়াশাসহ অতিরিক্ত শীতকেও দায়ী করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান আবহাওয়াটা ফসল উৎপাদনের অনুকূল নয়। ফলে কচি পাতা এবং ফুল ঝরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায় পানি প্রয়োগও এই ধরনের সমস্যার কারণ।’
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা কৃষকদের অতিরিক্ত পানি, সার প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছি। মাটির পিএইচ বাড়ানোর জন্য কিছু চুনজাতীয় ডলোমাইট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। গোলাপের জন্য যে পরিমাণ পিএইচ দরকার সেটা এর মাধ্যমে মাটিতে আনা সম্ভব। কিন্তু ওখানকার কৃষকরা আমাদের কথা শুনছেন না।’
উপজেলা থেকে কেউ পরিদর্শনে যাননি এমন অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পরিদর্শন করে এসেছি। এ ছাড়া সব সময়ই ফিল্ড অফিসাররা পরিদর্শন করেন। বিজ্ঞানীরা ওখানকার মাটি ও গোলাপগাছের পাতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। মাটির পিএইচের পরিমাণ কমে যাওয়াসহ তারা কিছু সমস্যার কথাও জানিয়েছেন।’