আগামী ২ মার্চ শেষ হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদ। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুজন উপাচার্য মেয়াদ শেষ করতে পারেননি, ছাত্র আন্দোলনে সরে দাঁড়াতে হয়েছে, সেখানে একজন নারী উপাচার্যের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করাকে একটি বড় সাফল্য বলেই মনে করছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
তবে মেয়াদকালে ফারজানা ইসলামের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে মিশ্র মতামত রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতাহের হোসেন যেমন অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে তহবিল আনতে পারাকে উপাচার্যের সাফল্য হিসেবে দেখেন, তেমনি এসব অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিকে ‘দুর্নীতির প্রশ্রয়’ হিসেবে দেখেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
পূর্বের দুই উপাচার্যের মতো অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধেও ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার বাসভবন ঘেরাও হয় এবং এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রশাসনিকভাবে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। করোনার সময় দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে না এসে বাসায় বসে কাজ করেছেন তিনি। শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন, এ দীর্ঘ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম চলেছে কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া।
ফারজানা ইসলামের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ২০১২-এর ৯ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
এ দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুই আওয়ামীপন্থি উপাচার্যের পতন হয়, যা সরকারের উচ্চমহলকে উপাচার্য নিয়োগে নতুন চিন্তা করতে বাধ্য করে। এ অবস্থায় প্যানেল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে দেশের প্রথম নারী উপাচার্য।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে অন্য এক ছাত্রলীগ কর্মী জোবায়ের নিহত হন। এতে দায়িত্ব শেষ হওয়ার ৯ মাস বাকি থাকতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় শিক্ষকদের আন্দোলনে উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রভাববলয় তৈরির জন্য গণহারে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ ও ছাত্ররাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে।
এরপর ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মালেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে মারা যান। এ ঘটনায় উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক সমিতি। ৯ মাস আন্দোলনে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার এবং দুই দফায় উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। অবশেষে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।
সরকার নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে প্যানেল নির্বাচনে ৩০ দিন সময় বেঁধে দেয়।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজে’র ব্যানারে অধ্যাপক আমির হোসেন, অধ্যাপক আবুল হোসেন ও অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নির্বাচনে অংশ নেন।
অন্যদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিবাদী চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষকদের জোট’-এর ব্যানারে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মতিন ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আফসার আহমদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পান নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। রাষ্ট্রপতি চার বছরের জন্য একজন নারী অধ্যাপককে প্রথমবারের মতো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আচার্যের নির্বাহী আদেশে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান ফারজানা ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা মনে করেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রথম মেয়াদের চার বছর মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন ফারজানা ইসলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ধারাও বজায় ছিল। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে ঘিরেও অস্থিরতা ও বিতর্ক দেখা দেয়।
প্রথম মেয়াদে ২০১৫ সালের অক্টোবরে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন, ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিন নির্বাচন, একই বছরের জুন মাসে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচন, অর্থ কমিটি ও শিক্ষা পর্ষদে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন তিনি। এর আগে কোনো উপাচার্যের সময় এক মেয়াদে এতগুলো প্রশাসনিক পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০১৮ সালে জাকসু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনও গঠন করা হয়। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সেশনজ্যাম উল্লেখজনক হারে কমে আসে।
ফারজানা ইসলামের আমলে নেয়া ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছয়টি হল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরও ১৫টি ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের কাজে এ মাসে শুরু হবে।
বিতর্ক পিছু ছাড়েনি
২০১৭ সালের ২৬ মে ২০১৭ সাভারের সিঅ্যান্ডবি এলাকায় বাসের ধাক্কায় জাবির দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ৪২ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে পরিস্থিতি শান্ত করতে ওই দিন রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালের মে মাসে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নতুন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। ‘বঙ্গবন্ধু আদর্শের শিক্ষক পরিষদ’ নামে এই সংগঠন আত্মপ্রকাশ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পরে শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন ঘটনায় প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে রাখে। এ সময় শিক্ষক সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পর্ষদের নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখলেও কোনো নির্বাচন দেয়নি প্রশাসন।
অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপেই ২ কোটি টাকা ছাত্রলীগকে দেয়ার অভিযোগ ওঠে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করে রাখেন। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের অনেকে আহত হন।
পরবর্তী সময়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে।
মহামারি-পরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক হলেও এখনও কর্মস্থলে ফেরেননি উপাচার্য। তিনি বাসায় বসে অফিস করায় দুই হাজারের বেশি ফাইল উপাচার্য অফিসে জমা পড়ে আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের মধ্যে জাকসুর নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দেন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম এবং ৩১ জুলাই জাকসু নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। কিন্তু এখনও তিনি তা করতে পারেননি।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হিসেবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সফল, দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও। কোনো রকম শিক্ষা পরিকল্পনা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে। করোনা মহামারিতে পরিকল্পনাহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দিনের পর দিন বন্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে তিনি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন।
‘আন্দোলন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ন্যায্য অধিকার পাওয়া অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান ছিল অপরিকল্পিত। তিনি ৬০৬ দিন বাসায় বসে অফিস করে রেকর্ড গড়েছেন। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় ৫৪ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে প্রশাসন। ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় এবং এটিকে তিনি বলেছেন “গণ-অভ্যুত্থান”। এগুলোই তার সাফল্য।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতাহের হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এনে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন। এ ছাড়া দুর্যোগকালীন শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখতে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাবি শাখার সভাপতি আবু সাঈদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই মেয়াদের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ফারজানা ইসলাম নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে পার হয়েছেন। তিনি যে দুর্নীতি করেছেন, তা সর্বমহলে প্রমাণিত। কিন্তু অদৃশ্যভাবে সেটিকে গায়েব করে ফেলা হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি।’
ছাত্রবান্ধব কাজ করার ফলেই তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি হতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল।
তিনি আরও বলেন, ‘কাজ করলে সমালোচনা হবেই। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন। বর্তমান ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট কমিয়েছেন পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাও বৃদ্ধি পেয়েছে।’