শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যকে নিয়ে সংকট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ক্যাম্পাসে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। দেরিতে হলেও সেই আলোচনা হতে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে শুক্রবার বৈঠক করবেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। শিক্ষার্থীদের আশা, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অপসারণে মন্ত্রী আশানুরূপ সমাধান দেবেন। প্রায় এক মাস অচলাবস্থার পর আবার স্বাভাবিক হবে শাবির ক্লাস, পরীক্ষা।
মন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, শুক্রবার সকালে দীপু মনি সিলেট যাবেন। তবে তিনি শাবি ক্যাম্পাসে যাবেন বিকেলে। বিকেল ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই শিক্ষামন্ত্রীকে ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছি। অবশেষে তিনি আসছেন। আমরা আশা করছি, তার সফরে আমাদের দাবিগুলো পূরণ হবে।
‘উপাচার্যের পদত্যাগের ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নেবেন এবং ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করবেন।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। ছবি: নিউজবাংলা
শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি নিতে বৃহস্পতিবার রাতে ক্যাম্পাসে বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র ইয়াসির সরকার বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষামন্ত্রী সরাসরি আমাদের সঙ্গে ফোনে ও ভিডিও কলের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে কথা বলেছেন। আমরা বিনীতভাবে আহ্বান করব, একই রকম আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমাদের দাবিগুলো সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেবেন।
‘উপাচার্যের অপসারণ, শিক্ষার্থীদের নামে করা মামলা প্রত্যাহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করতে শিক্ষামন্ত্রী কার্যকর উদ্যোগ নেবেন বলে আমরা আশা করছি।’
গত ১৬ জানুয়ারি থেকে উপাচার্য ফরিদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা আমরণ অনশন শুরু করলে ২২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী।
বৈঠকে দীপু মনি অনশন ভাঙার অনুরোধ করেন। সেই সঙ্গে আলোচনার জন্য তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। শিক্ষার্থীরা এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে মন্ত্রীকেই ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানান এবং উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক। ছবি: নিউজবাংলা
এরপর ২৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে ক্যাম্পাসে যান শাবির সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক। জাফর ইকবালের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহের অনশন ভাঙেন।
সরকারের উচ্চমহল থেকে আশ্বাস পেয়েই শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন জাফর ইকবাল।
অনশন ভাঙানোর পর এই আলোচিত অধ্যাপক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে আসার আগে আমার সঙ্গে সরকারের অনেক উচ্চমহল থেকে কথা বলেছে। আমি তাদের অনুরোধ করব, তারা আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো যেন রক্ষা করেন। আমি আর এই ছাত্রদের ভেতর কোনো পার্থক্য নাই।
‘আমাকে যে কথাটা দিয়েছেন তা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে বুঝে নেব তারা শুধু ছাত্রদের সঙ্গে নয়, আমার সঙ্গে এবং এই দেশের যত প্রগতিশীল মানুষ আছে সবার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কাজেই আমি আশা করব তারা যেন আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো রাখেন।’
ওই দিন বিকেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আবার কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। দাবি মেনে নেয়ারও আশ্বাস দেন। তবে উপাচার্য ফরিদ তার বাসভবন থেকেই বিশ্ববিদালয়ের দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে অপসারণের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় আবার ক্ষোভ বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের মাঝে।
এর মাঝে দীপু মনির শাবি ক্যাম্পাসে গিয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্তে আবারও আশা জেগেছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। সমাধানের আশায় আছেন শিক্ষক, কর্মকর্তারাও।
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলো এখন আর আমাদের হাতে নেই। এগুলো সরকারের হাতে চলে গেছে। তাই শিক্ষামন্ত্রীর সফরে চলমান সংকটের একটা সমাধান হবে বলে আশা করছি। আমরা সবাই তার আগমনের অপেক্ষায় আছি।’
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু ১৩ জানুয়ারি। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী।
১৬ জানুয়ারি বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে উপাচার্যকে মুক্ত করে পুলিশ।
১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে উপাচার্যকে মুক্ত করে পুলিশ। ছবি: নিউজবাংলা
এরপর পুলিশ ৩০০ জনকে আসামি করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন।
বাসভবনের সামনে অবস্থানের কারণে গত ১৭ জানুয়ারি থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ফরিদ উদ্দিন আহমদ।
১৯ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটা থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী।
তাদের মধ্যে একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অনশন শুরুর পরদিনই বাড়ি চলে যান। ২৩ জানুয়ারি আরও চারজন ও ২৪ জানুয়ারি একজন শিক্ষার্থী অনশনে যোগ দেন।
২৩ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অবরুদ্ধ উপাচার্যের জন্য প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির নেতা ও দুজন কাউন্সিলর খাবার নিয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের বাধায় তারা বাসভবনে ঢুকতে পারেননি। ২৮ ঘণ্টা পর ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করেন তারা।
২৬ জানুয়ারি অনশন ভাঙার পর জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হকের হাতে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচটি দাবি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য তুলে দেন।
এরপর ৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক পদ থেকে অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমদকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়, অসুস্থতার কারণে তাকে অপসারণ করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে প্রক্টরের পদ থেকে বৃহস্পতিবার আলমগীর কবীরকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দাবির মধ্যে জহির উদ্দিন আহমদ ও আলমগীর কবীরের অপসারণও ছিল।