জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেয়া ১০ বছরের কারদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা বহাল রেখে হাইকোর্ট রায় প্রকাশ করেছে। রায়ের পর এক মাসের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের এ নির্দেশনা অনুযায়ী এক মাসের মধ্যেই বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে আপিল বিভাগে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা।
৬৬ পৃষ্ঠার রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।
সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগ থেকে হাজী মো. সেলিমের সাহেবের যে রায় প্রকাশ হয়েছে, তাতে এক মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। আমরা তার (হাজী সেলিম) সঙ্গে কথা বলেছি। এখন হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী এক মাসের মধ্যেই বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে আমরা আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করব।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে আমরা যেটা দেখেছি, সেটা হলো ওনাকে ২৬ ধারায় যে নোটিশ দিয়েছিল এবং ২৬ ধারায় তথ্য গোপনের অভিযোগে যে মামলাটি দিয়েছেন। এ অভিযোগে হাইকোর্ট বিভাগ তাকে খালাস দিয়ে দেন।
আর ২৭ ধারায় তার কোন বৈধ আয়ের উৎস পায়নি বিধায় আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন। এটা ঠিক না। কারণ পুরো রায় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ওনার প্রতি বছরের ট্যাক্স ফাইলে যা আয় দেখানো আছে, তা কোনো আলোচনায় আসেনি। অতএব এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আপিল বিভাগে আপিল করব।
গত বছরের ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালত রায়ে জরিমানার টাকা অনাদায়ে হাজি সেলিমকে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
আত্মসমর্পণ না করলে জামিন বাতিল করে হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। চূড়ান্ত রায়ে তা বহাল রাখা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণের এক জায়গায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি একটি মানসিক রোগ। যা শুধুমাত্র শারীরিক শাস্তি দিয়ে নিরাময় করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, গোষ্ঠী চিহ্নিত করা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে দুদকের কাছে প্রত্যাশা করে আদালত বলেছে, সাংবিধানিক পদধারী বা নন পদধারীই হোক তাদের বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সংস্থাটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্দেশনার কারণেই দুর্নীতির উৎপাটন করতে আমরা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।
আমরা সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, এখন পর্যন্ত এই রকম হাজার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি দুদক। এর জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নির্ভর করে আছে।
রায়ে দুর্নীতিকে মানসিক ব্যাধি অ্যাখ্যায়িত করে বলা হয়, এতে বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষ আসক্ত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে দুদক, বিচার বিভাগসহ সরকারি এবং বেসরকারি এবং আদালতের প্রধানরা সমন্বিতভাবে তাদের সতর্ক করে বার্তা দিতে হবে। যদিও এই কাজ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। একজন সৎ ব্যক্তি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খপ্পরে পরে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও দুর্নীতিমুক্ত জাতি ও সমাজ গঠনে এই কাজ শুরু করতে হবে।
গত বছরের ৩১ জানুয়ারি এ মামলার আপিলের পুনঃশুনানি শুরু হয়। আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
হাজি সেলিমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদার ও তার ছেলে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস।
২০২০ সালের ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতে থাকা যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করে হাইকোর্ট। সে আদেশ অনুসারে নথি আসার পর আপিল শুনানির জন্য দিন ঠিক করা হয়।
২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করে। এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন হাজি সেলিম। এরপর ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে তার সাজা বাতিল করে।
পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি রায় বাতিল করে আবার হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।
পরে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, ৮ নভেম্বর তিনি দুদক থেকে এ মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরদিন ৯ নভেম্বর মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত করতে তিনি আদালতে আবেদন (মেনশন) করেন। এরপর আপিলটি কার্যতালিকাভুক্ত হওয়ার পর ওই বছরের ১১ নভেম্বর নথি তলব করে হাইকোর্ট।