রিকশার পেছনে গ্রামীণ জীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিভিন্ন ধরনের ফুল ও পাখির ছবি অনেকেই দেখেছেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো চত্বরে এমন চিত্র বিরল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসির চায়ের টংগুলোতে তেমনটাই করেছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তার বন্ধুরা।
শুধু টংই নয়, চায়ের কেতলি, বসার বেঞ্চ এবং পাশে যেসব গাছ আছে, সেগুলোতেও তুলে ধরা হয়েছে ‘রিকশা আর্ট’।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে। মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাতও হয় সে সময় থেকে।
বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পশৈলী এই রিকশা আর্ট। উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় এরই মধ্যে এটি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলের নজর কেড়েছে।
টিএসসির চায়ের দোকানে রিকশা আর্ট ফুটিয়ে তুলছেন একজন শিল্পী। ছবি: নিউজবাংলা
চায়ের টংয়ে কেন রিকশা আর্ট
স্বেচ্ছাশ্রমে রিকশাচিত্র আঁকছেন শিক্ষার্থী ও তাদের বন্ধুরা। রাত ১২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত তারা এ কাজ করেন।
গত সোমবার থেকে এই কাজ শুরু হয়। চলবে বৃহস্পতিবারও। এরপরই মূলত রিকশা পেইন্টের মূল সৌন্দর্যটা ফুটে উঠবে।
এ আর্টকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতেই টিএসসিতে আঁকাআঁকির পরিকল্পনা বলে জানান উদ্যোক্তাদের অন্যতম জেরিন সিনথি। তিনি ঢাবির চারুকলা অনুষদের ছাত্রী।
সিনথি নিউজবাংলাকে জানান, তার বন্ধু পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী ও মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ শিরিন আক্তার শিলা, একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সীমান্ত সাহা এবং রিকশা পেইন্টের একটা গ্রুপ এ কাজের সঙ্গে যুক্ত।
কাজটার ধারণা কীভাবে এলো জানতে চাইলে সিনথি বলেন, ‘টিএসসিতে বসেই আমাদের নিয়মিত চা খাওয়া এবং আড্ডা দেয়া হয়। শিলা একটা সামাজিক কাজ করার কথা ভাবছিল।
‘সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, সোশ্যাল ওয়ার্ক হিসেবে কোন কাজটা করলে ভালো হয়। এরপর টিএসসিকেন্দ্রিক কাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর গল্পে গল্পে রিকশা আর্টের কাজটা করা।’
চারুকলা অনুষদের এ ছাত্রী বলেন, ‘এখনকার অনেক বাচ্চাই আছে, যারা রিকশায় চড়ে না। তারা জানেও না রিকশার পেছনে এত সুন্দর একটা ঐতিহ্যবাহী পেইন্টিং থাকে। এই রিকশাচিত্র সম্পর্কে অনেকের আইডিয়া থাকে না। এই রিকশাচিত্র তুলে ধরার চিন্তা থেকেই এই কাজটা করা।’
সিনথি আরও বলেন, ‘টিএসসিতে প্রতিনিয়ত প্রচুর মানুষ আসে। তারা যদি এটি দেখে, তাহলে এ সম্পর্কে আরও জানবে। রিকশা আর্টের এই ঐতিহ্য যেন না হারায়, সে জন্য এই সুন্দর জিনিস নতুন করে তুলে ধরতে চেয়েছি।’
কেমন বোধ করছেন দোকানিরা
কোনো টাকা খরচ করা ছাড়া নিজেদের টংগুলো নতুন রূপ পাওয়ায় খুশি দোকানিরা। এই শিল্প মুগ্ধ করছে শিক্ষার্থীসহ টিএসসিতে আসা সবাইকে।
টং দোকান বসিয়ে টিএসসিতে চা বিক্রি করেন মোক্তার। তিনি বলেন, ‘২০০২ সাল থেকে আমি এখানে চা বিক্রি করি। এখন পর্যন্ত এই সুন্দর কাজটা কেউ করেনি।
‘চারুকলার ভাইরা বিনা মূল্যে এই কাজ করে দিছেন। তাদেরকে আমরা এক কাপ চাও খাওয়াতে পারি নাই। দোয়া করি উনারা জীবনে ভালো কিছু করুক।’
টিএসসির চা বিক্রেতা ‘স্বপন মামা’ বলেন, ‘কাজটা অনেক ভালো। এই আঁকাআঁকির কারণে এখন আমার দোকান চিনতে পারতেছি না। দেখতেও ভালো লাগতেছে।
‘মনে হচ্ছে, আগের চেয়ে কাস্টমারও বেশি আসছে। গত দুই দিন ধরে না ঘুমিয়ে তারা কাজগুলো করছেন। আল্লাহ উনাদের ভালো করুক।’
টিএসসির আরেক চা বিক্রেতা জালাল বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে বড় ভাই-আপুরা এখানে ফুল, পাখি আঁকছে। এগুলো এই জায়গার পরিবেশ সুন্দর করছে।
‘বাইরে থেকে যারা আসছে তারাও বলছে, কাজটা খুব সুন্দর হইছে। মানুষও আগের চেয়ে বেশি বসছে। আমার নিজেরই খুশি লাগছে।’