রাজধানীর ধানমন্ডিতে জোড়া খুনের হোতা ছিলেন ১০ বছর ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে আসা বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. বাচ্চু মিয়া।
স্বর্ণালঙ্কার লুটের সময় বাধা দেয়ায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগমকে। খুনের দৃশ্য দেখে ফেলায় হত্যা করা হয় গৃহপরিচারিকা দিতিকেও। বাচ্চু মিয়া নতুন গৃহকর্মী সুরভী আক্তার নাহিদাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটান এই জোড়া খুন।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান, পিবিআই অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের (উত্তর) পুলিশ সুপার আহসান হাবীব পলাশ।
রাজধানীর ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাসার ই-৫ ফ্ল্যাটে থাকতেন বৃদ্ধা আফরোজা বেগম। তার দেখভাল করতেন গৃহপরিচারিকা দিতি। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ভবনসহ ভিকটিমের ফ্ল্যাটের দেখভাল করতেন মো. বাচ্চু মিয়া।
দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে বিশ্বস্ততা অর্জন করে নিয়েছিলেন বাচ্চু মিয়া। লোভের তাড়নায় ‘বিশ্বস্ত’ তত্ত্বাবধায়ক সেই বাচ্চু মিয়াই নতুন গৃহকর্মী সুরভী আক্তার নাহিদাকে নিয়ে গৃহকর্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার লুটের পরিকল্পনা করেন।
২০১৯ সালের ১ নভেম্বর লোবেলিয়া অ্যাপার্টমেন্টের ওই বাসায় স্বর্ণালঙ্কার লুটের ঘটনায় বাধা দেয়ায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগমকে। খুনের দৃশ্য দেখে ফেলায় হত্যা করা হয় অপর কাজের মেয়ে দিতিকে।
ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলেও পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাচ্চুর প্রতি আস্থা আর বাচ্চুর লোভই কাল হয়েছে গৃহকর্ত্রীর জন্য। খুন হতে হয়েছে দুটো তাজা প্রাণকে। আর বাচ্চুর লোভের ফাঁদে পড়ে খুনের অংশীদার হয় নতুন কাজের মেয়ে সুরভী। সুরভী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে। খুব শিগগিরই আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দিবে পিবিআই।’
তিনি বলেন, খুনের ঘটনায় ৩ নভেম্বর মৃত আফরোজা বেগমের মেয়ে অ্যাডভোকেট দিলরুবা সুলতানা রুবা ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। ওই ঘটনায় ধানমন্ডি থানা ও ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ২৬ দিন তদন্ত করে মূল দুই আসামি বাচ্চু ও সুরভীসহ সন্দেহভাজন ৫ জনকে আটক করে। সুরভী দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
তবে মামলার বাদীর নারাজী ও পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে পিবিআই ওই বছরের ১ ডিসেম্বর তদন্ত শুরু করে।
পুনরায় গ্রেপ্তার সুরভী ও বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয় পিবিআই।
রিমান্ডে এসে সুরভীর দেয়া তথ্যমতে তার আগারগাঁওয়ের ভাড়া বাসার মাটি খুঁড়ে স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। এ সময় সুরভী মোবাইল বিক্রির কথা স্বীকার করে। সুরভী দোষ স্বীকার করে পুনরায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
হত্যার ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে আহসান হাবীব পলাশ বলেন, ‘মো. বাচ্চু মিয়া দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ভিকটিম আফরোজা বেগমের বাসায় বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে আসছিলেন। তবে বাচ্চু মিয়ার মধ্যে বিলাসী জীবন-যাপনের আকাঙ্খা ছিল। সেই আকাঙ্খা থেকে বাসায় অর্থ-সম্পত্তির প্রতি লোভ জন্মায়।’
ওই সময় আরও একজন গৃহকর্মীকে খুঁজছিলেন মামলার বাদী দিলরুবা। ওই সুযোগটিই কাজে লাগায় বাচ্চু। সুরভী আক্তার নাহিদা কাজের খোঁজে ধানমন্ডি আসে। পথে বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে পরিচয়, ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়। বাচ্চু মিয়া পরর্তীতে সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্ণালংকার লুটের পরিকল্পনা করেন।
বাচ্চু মিয়া সুরভী আক্তার নাহিদাকে প্রলোভন দেখায় ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে দিয়ে আগারগাঁও মার্কেট থেকে ছুরি কেনে। নাহিদাকে নতুন কাজের লোক সাজিয়ে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর ওই বাসায় যান। কাজের জন্য কথাবার্তা বলে। নাহিদা প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করে ও কিছু কাজও করে।
ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে বাচ্চু মিয়া বাসায় ঢুকে গৃহকত্রীর কাছে আলমারির চাবি চান। এসময় সুরভী ছুরি নিয়ে ভিকটিমের শয়ন কক্ষে যায়। চাবি দিতে না চাইলে বাচ্চু ও সুরভী ছুরি দিয়ে গৃহকর্ত্রী আফরোজার শরীরে, গলায় ও বিভিন্ন স্থানে একাধিক আঘাত করে জখম করে।
এরপর চাবি নিয়ে আলমারি খুলে ১টি স্বর্ণের চেইন, ২টি স্বর্ণের চুড়ি, ১টি মোবাইল সেট হাতিয়ে নেন। অপর কাজের মেয়ে দিতি পাশের কক্ষ থেকে দেখে ফেলায় তাকেও নাহিদা ছুরি দিয়ে একাধিক আঘাত করে গুরুত্বর জখম করে পালিয়ে যান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় দুজনই।
পরে পাশের ফ্ল্যাটেই বসবাসকারী গৃহকর্ত্রীর মেয়ে ও মামলার বাদী দিলরুবা কাজের লোক পাঠিয়ে জানতে পারেন খুনের ঘটনা।
শুধু লোভ থেকে খুন নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল জানতে চাইলে এসপি পলাশ বলেন, ‘গৃহকর্ত্রীর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে লোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বাচ্চু। স্বর্ণালঙ্কার লুটে বাধা পাওয়ায় দুজনকেই খুন করে বাচ্চু ও সুরভী।’
বাচ্চু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। শুধু সুরভীর কথায় কিভাবে বাচ্চুকে পিবিআই দোষী মনে করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবনের একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা, বাচ্চু ও সুরভীর মধ্যে সাক্ষাতের ভিডিও, তাদের মধ্যে মোবাইলফোনে কথোপকথনের তথ্যপ্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে বাচ্চুই পরিকল্পনাকারী। এই ঘটনায় পিবিআই দুজনের বিরুদ্ধে শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে।
অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজের লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিবিআইয়ের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। কাজের লোক নিয়োগের আগে নাম ঠিকানা যাচাই করা, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি রাখা, অপরিচিত কাউকে বাসায় কাজ না দেয়া, দীর্ঘ দিনের কাজের লোককে অতিরিক্ত বিশ্বাস না করা, মোবাইল নম্বর যাচাই ও ছবি রাখা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নিহতের মেয়ে ও বাদী দিলরুবা বলেন, ‘আস্থার জায়গা থেকে পিবিআইকে তদন্তের জন্য আমি ডিবির উপরে নারাজি দিই। পিবিআই সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। তারা লুট করা স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করেছে।’
সুরভী পুনরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সবকিছু স্পষ্ট করেছে। দ্রুত সম্ভব জড়িত দুজনের ফাঁসি দাবি করেন তিনি।