প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার জেরে ঢাকার সাভারে দশম শ্রেণির ছাত্রী নীলা রায়কে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ১৯ মে দিন ঠিক করেছে আদালত।
বুধবার ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফায়জুন্নেসা অভিযোগ গঠনের এই তারিখ ঠিক করেন।
এ মামলার মূল আসামি মিজানুর রহমানকে এদিন কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকা চার্জশিটভুক্ত অপর দুই আসামি মিজানুরের সহযোগী সেলিম পাহলান ও সাকিব হোসেনও এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সাকিবের পক্ষে আরিফা আক্তার রেবা এবং সেলিমের পক্ষে দিল মাহফুজা পারভীন পূর্বশর্তে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তাদের শর্তসাপেক্ষে জামিন আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনে শুনানির জন্য তারিখ ঠিক থাকলেও প্রস্তুতি না থাকায় রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষই চার্জ শুনানি পিছিয়ে দিতে মৌখিকভাবে আবেদন জানান।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম দস্তগীর আদালতে বলেন, ‘এই মামলার দীর্ঘ নথিপত্র দেখতে একটু সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। তাই প্রথম তারিখে চার্জ শুনানি করা সম্ভব নয়, তাই সময় চাচ্ছি।’
পরে বিচারক অভিযোগ গঠনের জন্য আগামী ১৯ মে ঠিক করেন।
২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নির্মল কুমার দাস আদালতে চার্জশিট জমা দেন। এরপর মামলাটি বদলি হয়ে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসে। মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯ ধারায় এই তিন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়।
এছাড়া মিজানুরের বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমুন্নাহার সিদ্দিকাকে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। অভিযোগপত্রে আটটি আলামতের কথা উল্লেখ করাসহ ১৮ জনকে সাক্ষী করা হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সাভার পৌরসভার পালপাড়া এলাকায় ১৪ বছর বয়সী নীলা রায়কে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।
ঘটনার পর ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের আরিচাঘাট এলাকা থেকে মিজানুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মানিকগঞ্জের চারীগ্রাম এলাকা থেকে একই দিন মিজানের বাবা ও মাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ওইদিন সাকিব ও জয়কে সাভারের রাজফুলবাড়ীয়া এলাকার একটি ইটভাটার পাশ থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জয়কে ছেড়ে দেয়া হয়। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক রাজিব আহসানের কাছে জবানবন্দি দেন মিজানুর রহমান।
এরপর মিজানুরের বাবা আব্দুর রহমান, মা নাজমুন্নাহার সিদ্দীকা এবং অপর দুই আসামি সাকিব ও সেলিম উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
মানিকগঞ্জ জেলার বালিরটেক এলাকার নারায়ণ রায়ের মেয়ে নীলা সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনির অ্যাসেড স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত। পৌর এলাকার কাজী মুকাম পাড়ার এক বাড়িতে তার পরিবার ভাড়া থাকতো।
নীলা রায়ের হত্যার ঘটনায় মিজান ও তার বাবা-মাকে আসামি করে সাভার থানায় হত্যা মামলা করেন নীলার বাবা নারায়ণ রায়। নারায়ণ রায় ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্পে একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন।
ঘটনার আগে বছর দেড়েক ধরে নীলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন কাজি মুকামপাড়ার পাশের এলাকা ব্যাংক কলোনির আবদুর রহমানের ছেলে কলেজ ছাত্র মিজান।
নীলা রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। তার ভাই অলক রায় তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাসা থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর মিজান রিকশার গতিরোধ করেন। এরপর অস্ত্রের মুখে নীলাকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পালপাড়া এলাকায় নিয়ে যান তিনি।
সাভার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের উল্টো দিকের একটি গলির ভেতরে নিয়ে নীলার গলায়, পেটে, মুখে ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে মিজান পালিয়ে যান। মেয়েটির চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে থানা রোডের প্রাইম হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় নীলার মৃত্যু হয়। পুলিশ জানায়, মিজান স্থানীয় একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এর আগে একবার টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি।
এজাহারে বলা হয়, আসামি মিজানুরদের বাড়ি ছিল এ ৬১/৪, দক্ষিণ পাড়া, ওয়ার্ড নম্বর ৪, সাভারে। আর তারা থাকতো ৭৪/২, ব্যাংক কলোনী, ওয়ার্ড নম্বর ৫, সাভারে। উত্ত্যক্তের বিষয়ে মিজানুরের বাবা মাকে বার বার জানানো হলে তারা বিষয়টির প্রতিকার না করে উল্টো বাদীর পরিবারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে।
ভাই অলক রায় ভয়ে সরে দাঁড়ালে নীলার হাত ধরে টেনে গলির রাস্তায় আসামিদের মালিকানাধীন বাউন্ডারি করা পরিত্যক্ত টিনের বাড়িতে নিয়ে যায়। নীলা কিছু বুঝার আগে আসামি মিজানুর তার ব্যাগ থেকে সুইস গিয়ার চাকু বের করে নীলাকে হত্যার উদ্দেশে এলোপাতাড়ি আঘাত করে নীলার ডান চোখের নীচে, বুকের ডান পাশে, পিঠের ডান পাশে, পেট, হাত, দুই উরুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখম করে।
একপর্যায়ে মিজানুর নীলাকে হত্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তার ব্যাগ থেকে ধারালো চাপাতি বের করে ঘাড়ের বা পাশে আঘাত করে। নীলা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারসহ গোঙাতে থাকলে অলকসহ আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে মিজানুর শরীরে রক্তমাখা অবস্থায় পালিয়ে যায়।
পরে হত্যায় ব্যবহৃত চাকু জব্দ করে পুলিশ।