রাজধানীর বিজয় সরণি ওভারব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে নানা বয়সী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। টিসিবির ট্রাক থেকে কিছুটা কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।
বুধবার বেলা ১টার দিকে ৩০-৩৫ জনের জটলা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছিল। আবার অনেকে অধৈর্য হয়ে চলেও যাচ্ছিলেন। কেউবা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পাশের গলি ও ফুটপাতে বসে পড়েন।
তাদের একজন রিকশাচালক শাফায়েত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে জিনিসের যা দাম, ইনকামে আর কুলায় না বাপু। দোকান থেইকে কিনতে গেলে ডাবল টাকা খরচ অয়। ইনকামও আগের মতো নাই।
‘আগে বউটা গার্মেন্টসে চাকরি করত। দুই বছর ধরে চাকরি নাই। তাই বউ-পোলাপাইন বাড়িত পাঠাইয়া দিছি। আগে বাসায় ছিলাম, এখন গ্যারেজে থাকি। মাস শেষে বাড়িতে যামু। তাই তেল, চিনি, ডাইল কিইন্না রাকমু মনে করছিলাম। এর লাইগা ৩ ঘণ্টা ধইরা দাঁড়ায় আছি। আরও ঘণ্টাখানেক দেখমু, তার পরও ট্রাক না আইলে চাইলা যামু।’
দেশের গড় আয় বাড়লেও তা নিম্নবিত্ত মানুষের লাভ-লোকসানের হিসাবে ধরা দেয় না। একই অবস্থা মধ্যবিত্তেরও।
অপেক্ষারত আরেকজন পঞ্চাশোর্ধ্ব হাসিনা বেগম বলেন, ‘দুই পোলা, এক পোলার বউ, দুই নাতি আছে বাসায়। এক পোলা সিকিউরিটির চাকরি করে। আরেকটা কারখানায় পিয়নের কাম করে। কোম্পানি করোনায় বেতন কমায় দিছিল, আর বাড়ায় নাই। পোলাগো একটু সাহায্য করার লাইগা এহানতুন তেল-চিনি কিনি। এয়ানে তেল দুই লিটার নেয় ২২০ টাকা, ডাইল-চিনি নেয় ৬০ টাকা। বাজারে গেলে মাতা ঘুরায়। দোয়ানে তেল ১৭০ টাকা, চিনি ৮০ টাকা, ডাইল ১২০ টাকা লাগব।’
শাফায়েত ও হাসিনা বেগম যখন সংসার চালাতে গিয়ে নিজেদের ত্রাহি অবস্থার কথা জানাচ্ছিলেন, তার আগের দিনই সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে যে গত এক বছরে মানুষের গড় আয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। শুধু গতকালের হিসাবেই বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। একজন মানুষের গড় আয় এখন প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আগের বছরও তা ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
এ নিয়ে কথা বললে হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমারডা বাড়ে নাই? আর যদি বাড়েই তাহলে আমার ভাগেরটা গেল কোনে?’
বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের গড় আয় বাড়লেও তা নিম্নবিত্ত মানুষের লাভ-লোকসানের হিসাবে ধরা দেয় না। একই অবস্থা মধ্যবিত্তেরও।
বাজারে পণ্যের দাম শুনে ক্রেতার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
কথা হলো বাসযাত্রী চাঁদপুরের বাসিন্দা ফজলে রাব্বীর সঙ্গে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে মা-বাবা ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করেন তিনি। মহাখালীর একটি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন। রাব্বি জানালেন, ‘করোনার প্রায় এক বছর প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। চাকরি ছিল না, আয়ও ছিল না। এখন চাকরি মিললেও বেতন কমে গেছে প্রায় ৬ হাজার টাকা।
‘এক বছর আয়-রোজগার বন্ধ থাকলেও সংসার খরচ তো থেমে থাকেনি। পৈতৃক জমি বিক্রি করে এক বছরের সংসার খরচ চালাইতে হইছে।’
কোনো পণ্যের দাম এক বছরের ব্যবধানে বাড়ার হিসাবই মূল্যস্ফীতি। গত ডিসেম্বরে তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬.০৫ শতাংশ হয়েছে। নভেম্বরে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি
বিবিএসের হিসাবে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বাড়ছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি। কোনো পণ্যের দাম এক বছরের ব্যবধানে বাড়ার হিসাবই মূল্যস্ফীতি। গত ডিসেম্বরে তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ হয়েছে। নভেম্বরে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
দাম বাড়ায় ক্ষেত্রেবিশেষে শহরকেও ছাড়িয়ে গেছে গ্রাম। ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হচ্ছে- গত বছরের ডিসেম্বরে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত এখন তা কিনতে লাগছে ১০৬ টাকা। এ সময় খাবার ছাড়া অন্যান্য পণের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। আর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
গত এক বছরের গড় হিসাবে ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যদিও সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নিয়েছে।
জিনিসপত্রের দাম আসলে কেমন
বাজারে জিনিসপত্রের দামের হিসাব রাখে টিসিবি। তবে তাদের হিসাবটা নিত্যপ্রয়োজনীয় মোট পণ্যের একটি অংশমাত্র। তবে সংস্থাটি বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে, তা মূল্যস্ফীতির হিসাবের সঙ্গে মেলে না। বেশির ভাগ পণ্যের দাম বৃদ্ধির হারই মূল্যস্ফীতির হিসাবের কয়েক গুণ।
চালের দাম বেশি বলে ভাত ছেড়ে আটা-ময়দায় ঝুঁকবেন তারও উপায় নেই। টিসিবির হিসাব বলছে- এক বছরে খোলা আটা ১১.২৯ শতাংশ বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা, প্যাকেট আটা ২৬.৮৭ শতাংশ বেড়ে ৪৫ টাকা, খোলা ময়দা ৩৭.৬৮ শতাংশ বেড়ে ৫০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা ২৭.৩৮ শতাংশ বেড়ে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবি তথা সরকারি হিসাব বলছে, মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে তেল, চাল ও মুরগির দাম। এক কেজি মোটা চাল কিনতেও এখন ৪৮ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সরু চাল এক বছর আগে ছিল ৬০-৬২ টাকা কেজি। এখন তা ৬৮-৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সে হিসাবে দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
চালের দাম বেশি বলে ভাত ছেড়ে আটা-ময়দায় ঝুঁকবেন তারও উপায় নেই। টিসিবির হিসাব বলছে- এক বছরে খোলা আটা ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা, প্যাকেট আটা ২৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়ে ৪৫ টাকা, খোলা ময়দা ৩৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়ে ৫০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুতে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৯০ টাকার আশপাশেই ছিল। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে দাম, যা এখন ১৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ১০৫ টাকার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। এ সময়ে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশের মতো।
টিসিবি বলছে, দাম বাড়ায় পিছিয়ে নেই ডালও। বড় দানার মসুর ডাল এক বছর আগে ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। মাঝারি মানের ডাল ৯০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ এবং দেশি বা ছোট দানার মসুর ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে বড় দানায় ৪৪ এবং মাঝারিতে ২৬ শতাংশ দাম বেড়েছে। অ্যাংকর বা বুট ডালের দামও ১৮ শতাংশ বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত বছরের এ সময় দেশি পিঁয়াজের দাম কিছুটা বেশি ছিল, কেজি ৩৫ থকে ৪০ টাকা। এবার বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ৩৫ টাকায়। তবে আমদানি করা যে পিঁয়াজ ওই সময় ২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। দাম বেড়েছে দ্বিগুণ বা ১০০ শতাংশ।
জিনিসপত্রের দাম কিন্তু একদিনে বাড়েনি। গত বছরজুড়েই ধীরে ধীরে দাম বাড়ছে। মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে পণ্য কিনছে। কেউ ছয় মাস পর বাজারে এলে পণ্যের দাম দেখে ভিরমি খাবেন।
কলমিলতা বাজারের মুদি দোকানি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম কিন্তু একদিনে বাড়েনি। গত বছরজুড়েই ধীরে ধীরে দাম বাড়ছে। মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে পণ্য কিনছে। কেউ ছয় মাস পর বাজারে এলে পণ্যের দাম দেখে ভিরমি খাবেন। যেমন, ছয় মাস আগে হুইল পাউডারের কেজি ছিল ৭০ টাকার মতো; এখন তা ১১০ টাকা। এভাবে সব জিনিসেই দাম একটু একটু করে বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে গেছে।’
মুরগির দামের বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই যে গত তিন মাস কী অবস্থায় ছিল। ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকায় উঠেছিল। এখন তা ১৫০ টাকায় নেমেছে। যদিও স্বাভাবিক সময়ে ব্রয়লার মুরগির কেজি থাকে ১২০-১২৫ টাকার মধ্যে।
সব সময় ১৮০-১৯০ টাকা কেজিতে ঘোরাফেরা করা সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৭০ টাকায়। কিছুদিন আগেই তা ছিল ৩০০ টাকার ওপর। মাংস ছেড়ে ডিম খাবেন সে উপায়ও নেই। ডিমের হালি ৩৮-৪০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে কয়েক মাস ধরেই।
সবজির বাজারের অবস্থাও সুবিধার নয়। শীত মৌসুমে সবজির দাম সব শ্রেণির ভোক্তার নাগালে থাকার কথা। অথচ বাজারে গ্রীষ্ম মৌসুমের চিত্র।
বাড্ডার সবজি বিক্রেতা মাসুদ হোসেন জানান, ‘শিম ৪৫-৫০ টাকা কেজি বেচতাছি। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৩৫-৪০, শসা ও ক্ষীরা ৫০-৫৫, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০, মাঝারি আকারের লাউ প্রতিটি ৭০-৮০ টাকা।
‘এ ছাড়া করলা, বেগুন ও বরবটির কেজি ৮০ টাকা, গাজর ও মুলা ৩০-৪০ টাকা, কাঁচামরিচের কেজি ৫০ টাকা, লেবুর হালি ৩০ টাকা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজারের এই পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস নেই।
পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে, তার সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের যথেষ্ট ফারাক থাকে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বিবিএসকে বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রকাশে মনোযোগ দিতে হবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম মঙ্গলবার প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব তুলে ধরা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’
আগের দিন সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চালের দাম কিছুটা হলেও কমেছে। ১০ টাকা কেজি দরে গরিবদের ওএমএসে চাল দেয়া হচ্ছে। এ কারণে খাবারের হাহাকার নেই। তবে দাম একটু বেশি, সেটা ঠিক। পিঁয়াজের দাম কম। কিছুটা মুদ্রাস্ফীতি আর আন্তর্জাতিক বাজারেই ভোজ্যতেলের দাম বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে, তার সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের যথেষ্ট ফারাক থাকে। এ জন্য পণ্যমূল্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বিবিএসকে বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’