বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খাদ্যের মজুত ২০ লাখ টন, তবু দাম বাড়ছে

  •    
  • ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:৩০

সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসাবে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য থাকলেই চলে। এখন খাদ্যের মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। শুধু চালের মজুতই ১৭ লাখ টন। অথচ বাজারে চালের দাম বেড়েই চলেছে। মন্ত্রী, চাল ব্যবসায়ী কারও কাছেই এর ব্যাখ্যা নেই।

সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ টনের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না, কিন্তু বিস্ময়কর হলো তারপরও চালের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বুধবার রাজধানীর বাজারগুলোতে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর সরু চাল (মিনিকেট-নাজিরশাইল) বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা কেজি দরে। এক বছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার দেশে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ২ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত হচ্ছে ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। গম ২ লাখ ৭৭ হাজার; আর ধান ৪৯ হাজার টন।

অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সরকারিভাবে চালের এত মজুত আগে কখনই ছিল না। গত বছর এই সময়ে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত ছিল ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন, যা মজুত হিসেবে ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে কম।

‘বর্তমান মজুত সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আমন ধান, চাল ও গম সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং বিদেশ থেকে চাল আমদানির কারণে খাদ্যশস্যের মজুতে রেকর্ড হয়েছে।

আমনের ভালো ফলন আর সবশেষ বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো চালের দাম কেজিতে অন্তত দুই টাকা করে বেড়েছে।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা; যা এক মাস আগেও ছিল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা।

মুদি দোকানের মালিক রিপন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বাড়েনি। তবে পুরোনো সরু চালের দাম দুই টাকার মতো বেড়েছে।’

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে মোজাম্মেল রাইস এজেন্সির আড়ত রয়েছে। এখান থেকে ঢাকা শহরে পাইকারি দামে চাল সরবরাহ করা হয়।

এই আড়তের কর্ণধার মতিউর রহমান তরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক মাস ধরে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বাজার বাড়তি। গত এক সপ্তাহেও এ দুটো চালের ৫০ কেজির বস্তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।’

তিনি জানান, নতুন মৌসুমের নাজিরশাইল চাল প্রতি কেজি ৫৮ টাকা এবং পুরান মৌসুমের চাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে দাম বেড়েছে ২ টাকা করে।

রেকর্ড মজুতের পরও কেন বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে, এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও ব্যবসায়ীরা।

চলতি আমন মৌসুমে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩ লাখ টন আমন ধান এবং ৫ লাখ টন সিদ্ধ আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

সোমবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুতদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকিসংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রেকর্ড পরিমাণ মজুতের পরও চালের চড়া দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘গতবার আম্পানে ধান নষ্ট হয়েছে। ভালো সংগ্রহ হয়নি। সর্বনিম্ন মজুত ছিল চার লাখ মেট্রিক টন। সেই সময়ও চালের দাম বাড়তে দিইনি। এবার বোরোতে যেমন বাম্পার ফলন হয়েছে, আমনেও বাম্পার ফলন। জাতীয় মজুত সর্বকালের সেরা, ২০ লাখ টনের বেশি। এখন চালের দাম বাড়ছে। এটা হাস্যকর। এখন চালের দাম বাড়াটা ভালো ঠেকছে না। হয়তোবা এই তিন বছর পরে আপনাদের কাছে আমার নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে। আমার এই তিন বছর বরবাদ গেল। আমার সারাজীবনের রাজনীতিই বরবাদ।

সম্প্রতি ঢাকায় ডি-৮ সম্মেলন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে চালের দাম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, চালের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। বাজারে চালও আছে পর্যাপ্ত। গত বোরো মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) ২ কোটি ৮ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

একই সময়ে সব ধরনের খাদ্যের উৎপাদনও বেড়েছে। মোটা চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা ১৭ লাখ টন, আলু এক কোটি ৬ লাখ টন এবং পেঁয়াজের উৎপাদন এক লাখ টন বেড়ে ৩৩ লাখ টন হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতেও চালের দাম বাড়ছে কেন, প্রশ্ন করা হলে কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘দাম বৃদ্ধির বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও একটা বড় কারণ হচ্ছে সম্প্রতি গমের দাম বেড়ে যাওয়া। গমের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়ে।

‘এখন গমের দাম চালের চেয়েও বেশি। যখন আটার দাম কম থাকে তখন মানুষ আটা খায়। এখন আটার দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ আটা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চাল খাওয়া শুরু করেছে।

‘প্রতি টন গম ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারে আমদানি করা যেত কয়েক বছর আগে। এখন তা আমদানি করতে হচ্ছে ৪৫০ ডলারে।’

টিসিবির হিসাবে দুই মাস ধরে আটার দাম বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় আটার দাম বেড়েছে ২৪ থেকে ৩৮ শতাংশ। খুচরা বাজারে এখন খোলা আটা ৩৮ টাকা আর প্যাকেট আটা প্রতি কেজি ৪৫ টাকা।

এদিকে চাল ও আটার দাম লাগামের মধ্যে রাখতে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীকে মূল্য সহায়তা প্রদান এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০১২ সালে ওএমএস ব্যবস্থা চালু করে সরকার। এ ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশব্যাপী ডিলারদের দোকান ও খোলা ট্রাকের মাধ্যমে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা ও আটা ১৮ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা একবারে সর্বোচ্চ ৫ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনাকালে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সরকারি গুদামগুলোতে এরই মধ্যে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত গড়ে তুলেছে। এখন আমাদের খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ২০ লাখ টনের বেশি। এই বাফার মজুত দেশে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি বাজার পর্যায়ে দাম সহনীয় রাখতে আমরা ওএমএস কার্যক্রমও জোরদার করেছি। উদ্দেশ্য এই করোনা পরিস্থিতিতে যাতে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ কম দামে চাল বা আটা কিনতে পারেন।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে চাপে আছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের আওতা বৃদ্ধি এবং দেশে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত কিছুটা হলেও ক্রেতা-ভোক্তার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করছেন দেশে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম জোরদার হলে বাজারে ওই পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যার সুফল ভোক্তারা পাবে।’

তিনি বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টন চাল থাকতে হয়। এর বাড়তি থাকা আরও ভালো। খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুত দিয়ে দেশে চাল ও আটার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি যে কোনো সংকট মোকাবেলা সম্ভব।’

কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মজুত বেড়েছে, এটা ভালো। কিন্তু দাম কেন বাড়ছে, সেটার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কারসাজি করে বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দাম বাড়িয়ে দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন বাড়বে; মজুত রেকর্ড হবে; দাম কমবে না- এটা মেনে নেয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘লকডাউন ও করোনার কারণে পেশা হারিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের অবশ্যই কম দামে খারাপ দিতে হবে।’

চালের দাম কেন কমছে না- এ প্রশ্নের উত্তরে চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার সঙ্গে মিলমালিকরা আদৌ দায়ী নন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ধান কিনে চাল উৎপাদন করি। অতিরিক্ত মুনাফা করলে আমরা দায়ী। আমরা কখনই অধিক হারে চালের দাম বাড়াই না। চালের দাম বাড়ানোর সঙ্গে আদৌ মিলাররা (চালকল মালিক) জড়িত নন। এমন অভিযোগের ভিত্তি নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর