দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ধাক্কা সামলে উঠেছে । একই সঙ্গে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে চলমান তৃতীয় ঢেউয়ে ব্যবসা পুনরুদ্ধার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ৩৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ পায়নি। উল্টো দুর্নীতিসহ নানা কারণে বেড়েছে ব্যবসার খরচ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সেবা খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে তিন মাস অন্তর জরিপ পরিচালনা করছে সানেম। এই পর্যায়ের জরিপে সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওমিক্রন ঢেউয়ের প্রভাবও তুলে ধরা হয়েছে।
সোমবার এক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জরিপের ফল তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
দেশের আটটি বিভাগের ৩৮টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে।
উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ প্রস্তুতকারক, হালকা প্রকৌশল এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপের আওতাভুক্ত ছিল। আর সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিক খাত এবং রিয়েল এস্টেট খাতও জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চলতি বছরের ৩ থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
তাতে দেখা গেছে, করোনা শুরুর পর ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াতে না পারলেও ২০২১ সালের একই সময়ে প্রায় ৬০ শতাংশই জানিয়েছে যে তারা ব্যবসা সচল করেছে। যদিও এই যাত্রায় সব খাত সমভাবে এগোতে পারেনি। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনার নতুন ধাক্কা সত্ত্বেও গড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে সেলিম রায়হান বলেন, জরিপ চালানো প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭১ শতাংশ জানিয়েছে যে ওমিক্রন সংক্রমণের প্রভাবে তাদের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। অন্যদিকে ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ওমিক্রনের জন্য সার্বিকভাবে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বেড়েছে। ওমিক্রনের কারণে রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ৮৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
জরিপে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও উঠে এসেছে। ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে যানবাহনের খরচ বেড়েছে। আর ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে তাদের উৎপাদন শক্তির খরচ বেড়েছে।
আগের পর্যায়ের জরিপের মতোই এ পর্যায়ের জরিপেও দেখা গেছে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, বন্ধক, দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, মহামারির আর্থিক ক্ষতি কাটাতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজেও বরাবরের মতোই উপেক্ষিত থেকেছে খুদে প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন ৭৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই কোনো প্রণোদনা পায়নি। উল্টো দুর্নীতিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে খরচ বেড়েছে।
অন্যদিকে প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশই জানিয়েছে যে তাদের জন্য ওই প্যাকেজ যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ সময় পর্যন্ত প্রায় ৬১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় আস্থা রেখেছিল। তবে চলমান তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে তাদের ৫৫ শতাংশই এখন রীতিমতো দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
জরিপে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ওমিক্রন সংক্রমণের ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় এবং তিন মাস অন্তর পরিক্রমাতেও ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে। তবে কোভিডের নতুন ধাক্কার কারণে সামনের তিন মাসের জন্য ব্যবসাগুলোর প্রত্যাশা তুলনামূলক কম।
আগের বছরের তুলনায়, অন্যান্য খাতের চেয়ে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ওষুধশিল্পের ব্যবসায় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ সচল রেখে টেকসই অর্থনীতি উন্নয়নে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে সানেম।
জরিপে পাওয়া তথ্যাবলি থেকে ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ‘ অ্যানাবলিং বিজনেস এনভায়রনমেন্ট ইনডেক্স (ইবিআই)’ তৈরি করেছে সানেম।
সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিদ্যুৎ, পরিবহন, দক্ষ শ্রমশক্তি, সম্পত্তি নিবন্ধন, অর্থায়নের সুবিধা, কর ব্যবস্থা, লজিস্টিকস, দুর্নীতি, সরকারি নীতিসহায়তা ও করোনা মহামারির ব্যবস্থাপনা।
২০২১ সালে সার্বিকভাবে এসব সূচকে কিছুটা পতন হলেও বর্তমানে উন্নতি হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসার পরিবেশে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উন্নতি হয়েছে। তবে ইবিআই সূচকের কিছু কিছু উপাদান যেমন কর, দুর্নীতি, দক্ষ শ্রমশক্তি, যানবাহনের মান, বাণিজ্য কাঠামো ও কোভিড ব্যবস্থাপনায় কিছু অবনতি দেখা গেছে। এ ছাড়া চামড়া ও আবাসন খাতে সূচকে কিছুটা অবনতি হয়েছে।