দুই প্রাণহানির মধ্য দিয়ে সপ্তম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়।
ভোটে দিনভর অন্যান্য ইউপিতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখা গেলেও সকাল থেকে অশান্ত ছিল সাতকানিয়া।
গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় সেখানকার দুই কেন্দ্রের ভোট স্থগিতও করা হয়েছে।
এ ছাড়া জাল ভোট দেয়া ও নির্বাচনি আচরণবিধি না মানায় কয়েকজনকে আটকসহ নৌকা প্রার্থীকে জরিমানার খবর পাওয়া গেছে অন্যান্য জেলার ইউপির কিছু কেন্দ্র থেকে। চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট স্থগিত করা হয়েছে একটি ইউনিয়নের।
সপ্তম ধাপে সোমবার ২০ জেলার ২৪ উপজেলার ১৩৮ ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে ৯ ইউনিয়নে ভোট হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। বাকি ১২৯টিতে ব্যালট পদ্ধতিতে।
সকাল ৮টায় শুরু হয়ে ভোট চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
নিউজবাংলার হিসাবে সোমবার দুই জনসহ গত জুন থেকে শুরু হওয়া ইউপি নির্বাচনে ছয়টি ধাপে অন্তত ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে, ষষ্ঠ ধাপে বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগে প্রার্থীর ভোট বর্জনের খবর মিললেও কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
পঞ্চম ধাপে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৩ জন। এ ছাড়া চতুর্থ ধাপে তিনজন, তৃতীয় ধাপে অন্তত ১০ জন, দ্বিতীয় ধাপের আগে পরে ১৬ জন ও প্রথম ধাপে সাতজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
অশান্ত সাতকানিয়া
সপ্তম ধাপে সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া ও বাজালিয়া ইউনিয়নে সহিংসতায় এক কিশোরসহ দুইজন নিহত হয়েছেন।
নিউজবাংলাকে স্থানীয়দের বরাতে সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল জানান, কেন্দ্র দখলের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে নলুয়া ইউনিয়নে মারফলা বোর্ডবাজার কেন্দ্রে দুপুরে নৌকার লিয়াকত আলী ও আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
সংঘর্ষের সময় ১৩ বছরের মো. তাসিফ নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
নিহতের বাবা মো. জসিমের দাবি, ওই ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থীর সমর্থকের ছুরিকাঘাতে তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
একই সময়ে বাজালিয়া ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রের বাইরে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন আহত হন।
তাদের স্থানীয় কেরানীহাট মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ১টার দিকে একজনের মৃত্যু হয়।
নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করে ওই ইউনিয়নের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিসান বিন মাজেদ জানান, আহত দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ভোট স্থগিত
একই উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের পর দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
খাগরিয়া ইউনিয়নের ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কেন্দ্রে সোমবার বেলা ১১টার দিকে ভোট স্থগিত করা হয়।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু তালেব মণ্ডল নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গণিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সোমবার সকাল ১০টার দিকে খাগরিয়া ইউনিয়নে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী আক্তার হোসেন ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মোটরসাইকেল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে ভোটকেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়।
খাগরিয়া ইউনিয়নের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বাঁশখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওমর ফারুক জানান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। তবে কারা গুলি করেছে তা জানা যায়নি। কেন্দ্রের পাশে ককটেল বিস্ফোরণও হয়।
স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ‘পিটিয়ে আহত’
এ দিকে সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর হাতিরপুল কেন্দ্রে সকালে ভোট শুরুর পরপর স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিম চৌধুরীর ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।
নৌকার প্রার্থী জসীম নিজে এ হামলা চালিয়েছেন দাবি করে ভুক্তভোগী প্রার্থীর চাচা নবাব চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৭ নম্বর ও ৮ নম্বর কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী জসীম নিজে এ হামলা করেছেন। আনারস প্রতীকের সেলিমকে মেরে গুরুতর আহত করা হয়েছে। তাকে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।’
এ ছাড়া নৌকায় প্রকাশ্য ভোট দেয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘উপজেলার ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রেও স্বতন্ত্রের এজেন্ট বের করে দিয়ে নৌকায় প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে।’
হামলার বিষয়ে সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল জলীল বলেন, ‘হামলার কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে একটু ঝামেলা হয়েছে শুনেছি, অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয়েছে ওই এলাকায়।’
অন্যদিকে কারচুপির অভিযোগে বাজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রে সকাল ১০টার দিকে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে চলছে বলে জানান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু তালেব মণ্ডল।
কুমিল্লায় আটক ৫, নৌকা প্রার্থীর জরিমানা
জাল ভোট দেয়া ও নির্বাচনি আচরণবিধি না মানায় সোমবার সকাল থেকে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ৫ জনকে আটক ও নৌকার এক প্রার্থীকে জরিমানার খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে বুড়িচং উপজেলার পীরযাত্রাপুর ইউনিয়নে চার যুবককে আটক করে পুলিশ।
গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রিপন সরকার জানান, আটকরা কেন্দ্রে এসে জাল ভোট দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটক করে।
দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়নে নির্বাচনি আচরণ ভঙ্গ করায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. নুরুল ইসলামকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অমিত দত্ত বলেন, ‘ভোটের আগেও দিন-রাত তিনি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে আলোকসজ্জা করায় তাকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়। সকালেও তিনি আচরণবিধি না মানায় তাকে জরিমানা করা হয়।’
একই উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নে এক প্রার্থীর সমর্থককে ৩৯ হাজার ৫০০ টাকাসহ আটক করা হয়। ভোট ক্রয়ের চেষ্টার দায়ে শাহজাহান নামের ওই ব্যক্তিকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এদিকে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যুতে দেবীদ্বার উপজেলার ভানী ইউনিয়নের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভানী ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বরুড়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম রোববার রাত ১২টার দিকে ভোট স্থগিতের কথা জানান।
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রথমে শুধু চেয়ারম্যান পদের ভোট স্থগিত করা হয়। পরে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব পদের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে ব্যালট ছিনতাই, ভোট বন্ধ
ব্যালট পেপার বই ছিনতাইয়ের অভিযোগে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পাইলট ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়েছে।
পানছড়ির ৫ ইউপির রিটার্নিং কর্মকর্তা রিকল চাকমা নিউজবাংলাকে বিকেল ৩টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সংরক্ষিত মেম্বার প্রার্থী মন্দিরা চাকমা অভিযোগ করে বলেন, ‘সাড়ে ১২টার দিকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী মো. আমিরুল বাশারের সমর্থকরা পাইলট ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ নম্বর বুথে ঢুকে চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত মেম্বার প্রার্থীর প্রতীক সম্বলিত ব্যালট পেপারের তিনটি বই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিবাদ জানালে আমাকে ও আমার এজেন্টদের মারধর করা হয়। বিষয়টি রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়য়েছি।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা রিকল চাকমা বলেন, ‘৩টি ব্যালট বই ছিনতাই হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে প্রিসাইডিং অফিসার আবেদন করেছেন। এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।’
ঠাকুরগাঁওয়ে বোমা বিস্ফোরণ, দূর্বৃত্তদের ধাওয়া
ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার নতুন ইউনিয়ন পরিষদ সেনুয়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী হাট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে হাত বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভোট কেন্দ্রে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ সময় এলাকাবাসী ও পুলিশের ধাওয়ায় ভোটকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যায় দূর্বৃত্তরা।
নিউজবাংলাকে ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ভোটার উম্মেদা খাতুন বলেন, ‘আমি ভোট দিতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ কেন্দ্রের পূর্ব পাশ থেকে বোমা বিস্ফোরণের বিকট আসে। শব্দে আমি চমকে উঠি।’
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেন্দ্রের বাহির থেকে একটি বিকট আওয়াজ এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি, তারা বিষয়টা দেখছেন।’
কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য বদিউজ্জামান বলেন, ‘কেন্দ্রের বাহির থেকে বিকট শব্দ আসার পর আমরা কেন্দ্রে তৎপরতা আরও বাড়িয়েছি। পুলিশ দূর্বৃত্তদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় সাধারণ জনগণও পুলিশকে সহায়তা করে।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসান সোহাগ বলেন, ‘কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’
ময়মনসিংহে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
ঈশ্বরগঞ্জে জালভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এ সময় ৮ থেকে ১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নে মরিচার চর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সোমবার বিকেল ৩ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল বাকি উল বারী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রত্যেক্ষদর্শী মো. খোকন বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি কেন্দ্রের পাশেই ছিলাম। জালভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করেই সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে আতঙ্ক ছড়ালে ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে কেন্দ্র।’
তিনি জানান, দুই মেম্বার প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, পুলিশ গিয়ে দ্রুতই পরিস্থিতি সামলে নেয়। ভোট সময়মতোই শেষ হয়েছে।