নানা ঘটনার পর অবশেষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ ফিরে পেয়েছেন অভিনেতা জায়েদ খান।
সোমবার তার করা এক রিটে হাইকোর্ট এ আদেশ দেয়। এর পরপরই প্রতিক্রিয়ায় জায়েদ খান বলেন, ‘রায়ে ন্যায়বিচার পেয়েছি। সবাই আমার দিকে, আমি আমার কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাব। সমস্ত মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।’
হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে তিনি আরও বলেন, ‘সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচনে আমি জয়লাভ করেছি। যত অভিযোগ নিপুণ আক্তার করেছে সবগুলো অবৈধ এবং নিজের মতন মনগড়া। শুরুতেই আমাকে মার্ডার কেসের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটাও একটা চাল ছিল।’
আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জায়েদ খানের প্রার্থিতা বাতিল করে রোববার চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আপিল বোর্ড নিপুণ আক্তারকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জয়ী ঘোষণা করেছিল।
ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে জায়েদ খানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সোমবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট আদেশ দিয়ে জায়েদের প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে।
আদালত আপিল বোর্ডের দুই সদস্য ও নিপুণকে নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন জায়েদ খানকে দায়িত্ব পালনে কোনো রকম বিরক্ত না করেন। এ আদেশের ফলে রুল নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত জায়েদ খানই চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকবেন।
রায়ের পর দুপুরে হাইকোর্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জায়েদ খান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আহসানুল করিম ও নাহিদ সুলতানা যুথি।
জায়েদ খান বলেন, ‘বিভিন্নভাবে শুরু থেকেই আমার পথ রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছ। আমি পরপর দুইবার সাধারণ শিল্পীদের ভোটে নির্বাচিত, সবশেষ নির্বাচনে তারা (কাঞ্চন-নিপুণ) ১০টা আর আমরা (মিশা-জায়েদ) ১১টা পদে জিতেছি।’
তিনি বলেন, ‘২৮ জানুয়ারি প্রাথমিক ফলাফল হলো, ২৯ তারিখে তারা (নিপুণ) আপিল করলে আমাদের সবার উপস্থিতিতে আপিল বোর্ড পুনর্গণনা করল, ব্যালট দেখানো হলো। উনি (নিপুণ) মেনে নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সিগনেচার দিয়ে চলে গেলেন। আপিল বোর্ড চূড়ান্ত ফলাফল নির্বাচন কমিশনকে পাঠাল।’
শিল্পী সমিতির তফসিলের কথা উল্লেখ করে জায়েদ খান বলেন, ‘আমাদের তফসিল অনুযায়ী ২৯ জানুয়ারি ৫টার পরে আপিল বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর ৩০ জানুয়ারি ৫টার পর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পরে নির্বাচন কমিশনও বিলুপ্ত।
‘আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো চূড়ান্তভাবে। এর পর সোহানুর রহমান এবং মোহাম্মদ হোসেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজের একটা চিঠি নিয়ে অবৈধভাবে একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, এটা আমাদের গঠনতন্ত্র এবং নির্বাচনি তফসিলের কোথাও উল্লেখ নেই। সেই চিঠি নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা অর্ডার আনা হয়েছে।’
জায়েদের দাবি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি যে আপিল বোর্ড তখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে নিজেরাই একটা মিটিং করে, নিপুণকে হাত ধরে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। সোহানুর রহমান সোহান একজন বিচারক, তিনি হাত ধরে কীভাবে বিজয়ী ঘোষণা করেন।’
এর আগেও দুবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এই অভিনেতা বলেন, ‘মিশা সওদাগর হেরে গিয়ে কাঞ্চন ভাইকে উইশ করেছেন। নিপুণ তার পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না। বাকি পদ ঠিক আছে, তার পদ নাকি ঠিক নাই।’
জায়েদ দাবি করেন, নির্বাচনের রাতে নিপুণ নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুনকে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে বলেছেন, বাতিল ভোটগুলো যেন তার পক্ষে দিয়ে দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনারের কাছে এ মেসেজ আছে বলেও দাবি করেন জায়েদ।
জায়েদ খান বলেন, ‘চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর কীভাবে প্রার্থিতা বাতিল হয়। প্রার্থিতা বাতিল হবে আচরণবিধিতে, সেটা নির্বাচন কমিশন করবে। তখন কোনো অভিযোগ নাই, সব মেনে নিয়ে আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পর এসব ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
তিনি বলেন, আপিল বোর্ডের আরেক সদস্য মোহাম্মদ হোসেন জেমী চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে ২৯ জানুয়ারির পর তাদের আর কোনো কার্যক্রম নাই।
জায়েদ তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি আমার কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাব। সব মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ডিপজল ভাই, রুবেল ভাই, রোজিনা আপা, অরুণা দি, মৌসুমী আপা। সবাই রোববার শপথ নেননি। তারা শনিবার রায় দিয়ে তাড়াতাড়ি করে রোববার শপথ নিয়ে নিয়েছেন।’
সোমবারই আবার এফডিসিতে যাবেন জানিয়ে জায়েদ বলেন, ‘আমি তো রানিং কাজই করছিলাম। তারা জোর করে বসে গেছে গায়ের জোরে। ফল ঘোষণার পর আমি আর কাঞ্চন ভাই অনুষ্ঠান করলাম, একসঙ্গে বসে কথা বলব সেসব পরিকল্পনা করলাম। হঠাৎ করে রোববার গায়ের জোরে আমার চেয়ার বের করে নতুন চেয়ার নিয়ে বসে গেল।’
জায়েদ খানের ব্যাপারে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের ব্যাপারে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথি সাংবাদিকদের জানান, সাত দিনের মধ্যে চূড়ান্ত শুনানি হবে।
গত ২৮ জানুয়ারি এফডিসিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের এই নির্বাচন ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। ভোটের আগেই দুই পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়ি হয়। ভোটগ্রহণের পরদিন ভোরে ফল ঘোষণা করে সমিতির নির্বাচন কমিশন।
২০২২-২৪ কার্যকরী পরিষদের এ নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মিশা সওদাগরকে হারান ৪৩ ভোটে।সাধারণ সম্পাদক পদে দুটি প্যানেল থেকে লড়াই করেন জায়েদ খান ও নিপুণ। জায়েদ খান ১৭৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর নিপুণের পক্ষে ভোট পড়ে ১৬৩টি।
ভোটে সভাপতি পদ নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও জায়েদ খানের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ভোটের সময় নিপুণ তার বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ আনেন। পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে একই অভিযোগ করেন তিনি।
ওই সংবাদ সম্মেলনে ভোট বাতিল দাবি করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহিদুল হারুনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনেন তিনি। তার কাছে পীরজাদা হারুন ভোটের দিন চুমু চেয়েছিলেন বলে দাবি করেন নিপুণ। অবশ্য হারুন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পরে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত জায়েদ খান ও কার্যকরী পরিষদ সদস্য পদে নির্বাচিত চুন্নুর প্রার্থিতা বাতিলের আবেদন করা করেন পরাজিত প্রার্থী নিপুণ।
এরপর প্রার্থিতা বাতিলের অভিযোগের দিকনির্দেশনা চেয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান চলচ্চিত্র সমিতির নির্বাচনের আপিল বোর্ডের প্রধান সোহানুর রহমান সোহান।
আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলে মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এফডিসিতে আসেন নিপুণ, আপিল বোর্ডের সদস্য সোহানুর রহমান সোহানসহ অনেকে।
এফডিসির বৈঠকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জায়েদের প্রার্থিতা বাতিল করে তার পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিপুণকে জয়ী ঘোষণার সিদ্ধান্ত আসে। সন্ধ্যায় বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে জানান সোহানুর রহমান সোহান।
এর পরদিন রোববার শপথ গ্রহণ করেন ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণসহ নির্বাচিত কয়েকজন। ইলিয়াস কাঞ্চনকে শপথ পড়ান নির্বাচনে সভাপতি পদে হেরে যাওয়া মিশা সওদাগর।
এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান জায়েদ খান। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।