নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের বড়খোল গ্রামে জমির মালিকানা বিরোধে চারটি পরিবারকে সাত মাস ধরে একঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
জেলা প্রশাসক বরাবর এ ঘটনার সুষ্ঠু প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করে এখনও প্রতিকার পায়নি ছামছুর দেওয়ান, তার ভাই উজ্জল দেওয়ান, শরিকান রমজান দেওয়ান এবং মোমেনা বিবির পরিবার।
এ অবস্থার মধ্যে গত শুক্রবার বিকেলে ভুক্তভোগী চার পরিবারের সদস্য রমজান ও কালামকে বেদম মারধরেরও অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় রমজানকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, বড়খোল উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি নিয়েই মূলত বিরোধের সূত্রপাত। জায়গা ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে পার্শ্ববর্তী খাসজমিতে বসতি স্থাপনের জন্য তাদের প্রস্তাব দিয়েছেন গ্রামের কয়েক মাতাব্বর এবং ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
প্রস্তাব মেনে জায়গা না ছাড়লে সাত মাস আগে গ্রামের মাতব্বর আব্দুল করিম, রিয়াজুল ইসলাম, বেলাল ও প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন ওই চার পরিবারকে একঘরে করার ঘোষণা দেন। এ ছাড়া জায়গার মালিকানা দাবি করে স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে একটি মামলাও করা হয়।
ভুক্তভোগী ছামছুর দেওয়ান জানান, মাতব্বর রিয়াজ দেওয়ান নিজে এসে চার পরিবারকে একঘরে করে রাখার বিষয়টি জানান। তাদের সঙ্গে কথা বলাসহ তাদের দোকান থেকে কোনো কিছু কেনাকাটা করতে সবাইকে নিষেধ করেন। কেউ নির্দেশ অমান্য করলে তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলেও সমাজের সবাইকে সাবধান করে দেন।
ছামছুর দেওয়ান বলেন, ‘এর পর থেকেই আমাদের সঙ্গে কেউ কথা বলে না, দোকান থেকে জিনিসপত্র কেনে না। আমাদের ভ্যান গাড়িতেও কেউ যাতায়াত করে না। আমাদের চলাচলের রাস্তাও ইটের প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হতে চাইলে এই প্রাচীর টপকাতে হয়। চার পরিবারের মোট ২১ জন এই দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।’
ওই গ্রামের ইকবাল হোসেন, খায়রুল ইসলাম প্রামানিকসহ কয়েকজন জানান, মাতাব্বরদের নির্দেশে তারাও ওই চার পরিবারের কারো সঙ্গে কথা বলেন না।
প্রতিকার চেয়ে ছামছুর দেওয়ান নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে গত বছরের ২৭ অক্টোবর তিনি রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘ব্যক্তিগতভাবে দেখে অবহিত’ করার নির্দেশ দেন। পরে নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেলেও এখনও কোনো সমাধান আসেনি।
এদিকে গ্রামের মাতব্বর আব্দুল করিম একঘরে করে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ছামছুর দেওয়ানরা খারাপ মানুষ। তাই গ্রামের মানুষ ঘৃণা করে তাদের সঙ্গে কথা বলে না। এ ছাড়া তারা নিজেরাই নিজেদের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করেছে। আমরা করিনি।’
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর চলাচলের পথে সীমানা প্রাচীর ওঠানোরও অভিযোগ উঠেছে
বড়খোল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘স্কুলের কিছু জায়গা ওই চার পরিবারের সীমানার মধ্যে পড়েছে। স্কুল ঘেঁষে তাদের বাড়ি। তাই জমি মাপার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু তারা মানছে না যে, তাদের জায়গার মধ্যে স্কুলেরও কিছু জায়গা আছে।’
গত সাত মাস ধরে জমি নিয়ে স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে একটি মামলা চলমান আছে। আদালত এখনও তার রায় দেয়নি। এ অবস্থায় তাদের একঘরে করে রাখা কতটুকু যুক্তিসংগত- এমন প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। এটা গ্রাম্য মাতব্বর ও স্কুল কমিটির বিষয়’ বলেই তিনি ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে মিরাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফেজ মো. জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে শপথ নিয়েছি। বিষয়টি জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
রাণীনগর থানার ওসি শাহীন আকন্দ বলেন, ‘একঘরে করে রাখা এবং মারধরের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং উভয় পক্ষকে আমার দপ্তরে ডেকেছি। আশা করছি, তারা আসবেন এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে এর সমাধান হবে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, ‘একঘরে করে রাখার বিষয়টি সুরাহার জন্য ইউএনওকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেহেতু এখনও সমাধান হয়নি, আমি দেখছি কিভাবে সুরাহা করা যায়।’