‘বাসা থেকে বের হয়ে দেখতাম বাচ্চারা খেলছে। বাসার ভেতর থেকেও ওদের উচ্ছ্বাস, চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যেত। আজ ছয় দিন ধরে কোনো বাচ্চা মাঠে যেতে পারে না। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মাঠে প্রবেশ আটকে রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে মাঠে খেলে বড় হয়েছে, সেই মাঠটা আজ বন্ধ। খেলার মাঠ বন্ধ করে এখানে থানা হবে। আমরা খেলার মাঠে থানা চাই না।’
শনিবার দুপুরে রাজধানীর কলাবাগান তেঁতুলতলা মাঠসংলগ্ন মসজিদ থেকে বেরিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব আনিসুল হক। শুধু তিনি নন, কলাবাগান লেক সার্কাস গার্লস স্কুলের পেছনে ছোট মাঠটুকু রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে শিশু, যুবকসহ সব শ্রেণির মানুষ।
তেঁতুলতলা মাঠ নামে পরিচিত এই জায়গাটুকু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এলাকার শিশু-কিশোররা এই মাঠেই খেলাধুলা করে আসছে।
তবে ৩১ জানুয়ারি মাঠে প্রবেশ ঠেকিয়ে দখল নিতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে পুলিশ। কারণ হিসেবে বাহিনীটি বলছে, এই জমিতে কলাবাগান থানা হবে। বর্তমানে থানাটি একটি ভাড়া ভবনে আছে। এই তেঁতুলতলা মাঠে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করা হবে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এলাকার সব শ্রেণির মানুষ মিলে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, লেক সার্কাস গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে একটু হেঁটে সামনে গেলেই হাতের বাম পাশে একটি খোলা জায়গা। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে ওয়াসার পাম্প। একই পাশে দেয়াল ঘেঁষে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় একটি ছোট ঘর, যেখানে মরদেহের গোসল করানো হয়। আর মাঝ বরাবর রয়েছে মিম্বর। জানাজা ও ঈদের জামাতে যেটি ব্যবহার হয়।
আরও দেখা গেছে, একেবারে পূর্ব পাশে কিছু জায়গাজুড়ে ফেলা হয় ময়লা। খালি জায়গাটার দুই পাশে থাকা গোসলখানা, মিম্বর ও ময়লা ফেলার জায়গাটুকু বাদে বাকি অংশটুকু ব্যবহার হয় খেলার মাঠ হিসেবে।
দিনভর শিশু-কিশোররা নানা খেলায় মেতে থাকে এই মাঠে। বড়দেরও টুর্নামেন্ট আয়োজন হয় এখানে। এ ছাড়া জাতীয় দিবসগুলো ঘিরে এলাকাবাসী আয়োজন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
মাঠে স্থানীয়দের প্রবেশ ঠেকাতে পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারা। ছবি: নিউজবাংলা
তবে সবই বন্ধ এখন। প্রায় এক বিঘা জমির উত্তর পাশের অংশে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ায় ভেতরে যেতে পারছে না কেউ। থানা ভবন হবে মাঠে। কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার পর দখল টিকিয়ে রাখতে সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছে পুলিশের পাঁচ সদস্যের একটি দল।
শনিবার দুপুরে এই তেঁতুলতলা মাঠে কাঁটাতার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আট বছর বয়সী রাজনকে। তার মা গৃহকর্মী। এই মাঠে সে নিয়মিত খেলত। তবে এখন মাঠেই ঢুকতে পারছে না। ছয় দিন ধরে খেলাও বন্ধ।
শিশু রাজন খেলার মাঠ খুলে দেয়ার দাবি করছে।
রাজন বলে, ‘রাস্তায় খেলা যায় না, গাড়ি চলে। মাঠে খেলবার চাই। পুলিশ যাইতে দেয় না।’
এই রাজনের মতো শিশু-কিশোররা শুক্রবার মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। তারা এই তেঁতুলতলা মাঠটি কোনোভাবেই কারও হাতে দিতে চায় না।
কলাবাগানের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তেঁতুলতলা মাঠের এক বিঘা জমি একজন বিহারির মালিকানায় ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। এর পর থেকেই জায়গাটি খেলার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে।
দীর্ঘদিন জায়গাটির মালিক না থাকায় দফায় দফায় দখলের চেষ্টা হয় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দা রত্না।
তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালীরা এ মাঠটি বারবার দখলের চেষ্টা করেছে। স্থানীয়রা সেটা প্রতিহত করেছে। এখন পুলিশ দখল নিয়েছে। আমরা বিচারের জন্য যাদের কাছে আশ্রয় নিতাম, তারাই দখল নিয়েছে।’
সৈয়দা রত্না বলেন, ‘আমাদের এই এলাকায় আর কোনো মাঠ নেই। আমি, আমার পূর্ব প্রজন্ম ও পরের প্রজন্ম সবাই এই মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। শিশুরা খেলার মাঠ না পেলে কোথায় যাবে?’
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় মেয়র প্রতিটি এলাকায় মাঠ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন দেখছি, যেটা আগে থেকেই মাঠ ছিল সেটা এখন দখল করা হচ্ছে সরকারিভাবে। যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, এই মাঠটি তাদের নয়। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশকে থানার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’
কোনো পরিস্থিতিতেই এ মাঠটি দখল হতে না দেয়ার কথা জানান সৈয়দা রত্না।
তিনি বলেন, ‘এই মাঠ দখল হয়ে গেলে এলাকায় শিশু-কিশোররা খেলবে এমন কোনো আর মাঠ থাকবে না। আমাদের সন্তানরা কোথায় খেলতে যাবে? তাদের বিকাশের জন্য এই খেলার মাঠটি প্রয়োজন। মাঠ বন্ধ করে কেন স্থাপনা করতে হবে? আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তেঁতুলতলা মাঠটি রক্ষা করা প্রয়োজন।’
কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র বলেন, ‘সরকার তার জমি থানার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জমিটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন জমিটি ৩১ জানুয়ারি বুঝিয়ে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে আমাদের কিছু বলার থাকবে না। এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, এই জায়গায় কলাবাগান থানা হবে।’