বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হারিয়ে যাচ্ছে ধানের গোলা

  •    
  • ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:৪০

পুরো ফরিদপুর জেলায় এখন একমাত্র ধানের গোলাটি টিকে আছে সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে কৃষক অধীর কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে। মাঠের ধান এখনও গোলাতেই রাখেন তিনি।

ফরিদপুর থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধানের গোলা। এককালে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বাড়িতে ধানের গোলার প্রচলন ছিল। প্রবাদে আছে, ‘গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ।’

এখন মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুত করার জন্য বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি ধানের গোলা। অথচ একসময় সমাজে বিত্তের মাপকাঠি ছিল বাড়িতে ধানের গোলার আকৃতি ও সংখ্যা। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন তা ইতিহাস। প্রবীণদের কাছে স্মৃতি।

পুরো ফরিদপুর জেলায় এখন একমাত্র ধানের গোলাটি টিকে আছে সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক অধীর কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে। মাঠের ধান এখনও এই গোলাতেই রাখেন তিনি। পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বাড়ির উঠানে তিনি এটি যত্ন করে রেখেছেন। আগেকার দিনের মতোই ব্যবহার করছেন।

অধীর কুমার বিশ্বাস জানান, তার গোলাটির বয়স হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ বছর। ১০০ মনের ওপরে ধান রাখা যায় এটিতে। নিজের জমির সব ধান তিনি এই গোলাতেই রাখেন। অনেক যত্ন করে এটি ব্যবহার করা হয়। মাঝেমধ্যে সংস্কারও করেন। ধানের মৌসুমে ধান কেটে শুকিয়ে গোলায় রাখা হয়। প্রয়োজনের সময় গোলা থেকে ধান বের করে রোদে শুকিয়ে ধান ভাঙানো হয়।

অধীর কুমার বলেন, ‘আগেরকার যুগে সম্পন্ন গেরস্ত বলতে ফসলের ক্ষেত, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর গোলাভরা ধান বোঝাত। এখন আর আগের মতো কেউ এভাবে ধান রাখে না। বস্তায় করে গোডাউন অথবা ঘরের মধ্যে রেখে দেয়।’

তিনি জানান, গোলা বানাতে প্রথমে বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে গোলাকৃতির কাঠামো তৈরি করা হয়। এঁটেল মাটির কাদা তৈরি করে ভেতরে ও বাইরে আস্তরণ লাগিয়ে ওপরে টিনের চালা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হয় ধানের গোলা। প্রবেশপথ বেশ ওপরে, যেন চোর বা ডাকাত সহজে ধান নিতে না পারে। ইঁদুর ঢুকে ক্ষতি করতে পারে না। গোলায় শুকানো ধানের চাল শক্ত হয়। তখনকার কৃষকদের কাছে এটিই ছিল ধান সংরক্ষণের আদর্শ পন্থা।

নতুন প্রজন্মের অভিজ্ঞতায় নেই বলে অনেকে এসে জানতে চায় উঠানে এটা কী?

উপজেলা সদরের সদরদি গ্রামের বাসিন্দা মো. সজীব মোল্লা ফরিদপুর সিটি পেজের মডারেটর হিসেবে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন। ধানের গোলা এর আগে কখনও দেখেননি তিনি, চিনতেনও না।

তিনি বলেন, ‘আমার গ্রামের পাশেই কৃষ্ণনগর গ্রামে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী একটি মাত্র ধানের গোলার অবস্থান, তাও এত দিনে জানতে বা চিনতে পারিনি। আমাদের প্রজন্মের কাছে এটা রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।’

মধুখালী উপজেলার মেকচামী ইউনিয়নের বামুন্দী গ্রামের বাসিন্দা ও প্রবীণ শিক্ষক প্রভাষ মণ্ডল জানান, এখন আর গোলার প্রচলন নেই। চোখেও পড়ে না। ড্রাম বা বস্তাতেই ধান রাখা হয়।

বোয়ালমারী উপজেলা সদর এলাকার বাসিন্দা, সংস্কৃতিকর্মী আমীর চারু, সুমন খানসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, তারা কেউ আর গোলা দেখতে পান না কারো বাড়িতে। গোলা নির্মাণের জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন সেই গোলা নির্মাণের শ্রমিকই পাওয়া যাবে না।

কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী হাসান ফিরোজ ও সমর চক্রবর্তী জানান, তারা বাপ-দাদার আমল থেকে দেখেছেন ও শুনেছেন গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। অন্য জেলায় কিছু কিছু দেখা গেলেও তাদের জানা মতে ফরিদপুরে নেই। গোলাগুলো এককালে কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য বহন করত।

সালথা, সদরপুর, নগরকান্দা ও ভাঙ্গা এলাকার একাধিক প্রবীণ জানান, বর্তমানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও যান্ত্রিক চাষাবাদ ওলট-পালট করে দিয়েছে গ্রামাঞ্চলের চালচিত্র। ধানের গোলার মতো ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আরও অনেক কৃষি ঐতিহ্য ও কৃষ্টি।

ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হযরত আলী জানান, আশির দশকের দিকেও ধানের গোলা কৃষক ও সাধারণ মানুষ ব্যবহার করত। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মানুষের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। ফলে ঐতিহ্যবাহী এসব ধানের গোলার জায়গা দখল করে নিয়েছে পাটের বস্তা। এগুলো তৈরি ঝামেলামুক্ত ও সহজে বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষ বাঁশের গোলার পরিবর্তে এসব আধুনিক উপকরণ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর