রেলস্টেশনের বাইরে করিডরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে আছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। মাথার ওপরে রেলস্টেশনের ছাদ থাকলেও সামনের দিকে দেয়াল নেই। বাতাস ঢুকছে হু হু করে, সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটাও এসে পড়ছে দু-একটি। এর মধ্যেই জবুথবু হয়ে শুয়ে আছেন তারা। কেউ আছেন কম্বল মুড়ি দিয়ে, কেউবা চটের বস্তায় গা ঢেকে।
মাঘের শেষে এসে তীব্র শীত পড়েছে সিলেটে। হাঁড়-কাপানো শীতের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। দিনে সূর্যের দেখা নেই, রাত হলে শীত আরও জেঁকে বসে। ফলে ঘরে থাকাও দায়। কিন্তু যাদের ঘরই নেই, এই শীতে কেমন আছেন তারা?
শুক্রবার মধ্যরাতে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা হয় এমন কয়েকজনের সঙ্গে।
কাছে গিয়ে ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলেন একজন। তার ওঠার শব্দ পেয়ে আরও কয়েকজন উঠে বসলেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
এর মধ্যেই শিশু আরিফের জিজ্ঞাসা- ‘ওবা মামু, ছবি তুলো কেনে, কম্বল দিবায়নি?’
যেন কম্বলের আশায় আরও দু-একজন উঠে এলেন ঘুম থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কম্বল বা এ রকম কিছু পাওয়ার আশা নেই দেখে হতাশ হয়ে আবার শুয়ে পড়লেন নিজেদের অস্থায়ী বিছানায়।
যাওয়ার আগে সাইফুল নামের একজনের আবদার ‘কম্বল না দিলেও ৫টা টাকা অন্তত দিয়ে যাও।’
টাকা হাতে ধরিয়ে দিলে আলাপ জমান সাইফুল। সিলেট নগরের কিনব্রিজে ‘ঠেলার’ কাজ করেন তিনি।
ধনুকের মতো বাঁকানো কিনব্রিজে যাত্রী নিয়ে রিকশা টেনে তুলতে পারেন না চালক। পেছন দিকে ধাক্কা দিয়ে আরেকজন রিকশা ব্রিজের ওপর তুলতে সাহায্য করেন। সিলেটে এদের পরিচয় ‘ঠেলাওয়ালা’ হিসেবে।
কিনব্রিজে শতাধিক মানুষ এই ঠেলাওয়ালার কাজ করেন। সাইফুল তাদের একজন। বাড়ি কুড়িগ্রামে।
সাইফুল বলেন, ‘মাসখানেক আগে সিলেট এসেছি। কিনব্রিজে ঠেলাওয়ালার কাজ করি। এখানে থাকার কোনো জায়গা নেই। তাই রাতে রেলস্টেশনে ঘুমাই।
‘শীতের মাঝে বাইরে ঘুমানো ম্যালা কষ্ট। ঠান্ডায় শরীর জমে বরফ হই যায়। মশায় কামড়াইয়া গায়ে জ্বলা তুলে ফেলে। আর আজকে বৃষ্টির দিনে তো আরও ঝামেলা। বৃষ্টির ফোঁটা আইসা ওপরে পড়তেছে। তবু যাওয়ার কোনো জায়গা নাই।’
রজব আলী নামের এক ভবঘুরেও শুয়ে আছেন এখানে। রজবের ভাষায়, ‘আমি কিছুই করি না। কেউ দিলে খাই, না দিলে উপোস থাকি। আর রাইতে এসে এখানে ঘুমাই।’
মাঝেমধ্যে লোকজন এসে কম্বল, শীতের কাপড় দিয়ে যায়।
নিজের গায়ে জড়িয়ে থাকা কম্বল দেখিয়ে বলেন, ‘এইটা দুই দিন আগে এসে একদল লোক দিয়ে গেছে। তবে এই পাতলা কম্বলে শীত কাটে না। রাত বাড়লে শীত আরও বাড়ে। তখন আগুন জ্বালাইয়া থাকি।’
তবে এইবার তিনটি কম্বল পেয়েছে বলে জানায় রেলস্টেশনে শুয়ে থাকা শিশু মুহিব হোসেন।
মুহিব বলে, ‘আমি তিনটা কম্বল পাইছি। দুইটা ১৬০ টেকায় বেইচা দিছি। একটা আমার কাছে আছে।’
মুহিবের কথা শুনে তার দিকে খিস্তি মেরে তেড়ে আসেন পাশেই বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন। বলেন, ‘আমরা একটাও পাই না, তুই তিনটা কম্বল নিছিস কেন?’
এই তর্কে এসে যুক্ত হন আশেপাশে থাকা আরও কয়েকজন। নিজেদের মধ্যে রীতিমতো ঝগড়া লেগে যায় তাদের। হল্লা করে যেন শীত তাড়ানোর চেষ্টা তাদের।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘শীতে ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট লাঘবে আমরা চেষ্টা করছি। বৃহস্পতিবার রাতেও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০০ কম্বল বিতরণ করেছি।’