৪৯ বছর আগের কথা। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের ছোট্ট একটি কক্ষে চক্ষুসেবা দিতে শুরু করে জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি নামের একটি সংগঠন। মরহুম এ কে খান জহুর আহম্মদ চৌধুরী, ডা. ছমিউদ্দীন, ডা. এস আর দাশ এবং ডা. রবিউল হোসেন নিয়েছিলেন সে উদ্যোগ।
মাত্র ৩ হাজার ৬০০ টাকার পুঁজিতে পথচলা শুরু তাদের। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হন পশ্চিম জার্মানির ‘আন্দেরি হিলফি’ নামের একটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট রোজি গোলমম্যান।
সময়ের কালক্রমে বাড়তে থাকে সেবার কলেবর। ছোট্ট কক্ষ থেকে ব্যাপ্তি বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২ লাখ বর্গফুট আয়তনে। সেখান থেকেই লাখ লাখ মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের কাছে এটি পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল নামেই পরিচিত।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশকে এসে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে লাখো মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিষ্ঠানে। চোখের চিকিৎসায় শুধু চট্টগ্রামই নয়, পুরো দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে হাসপাতালটি।
চোখের চিকিৎসা নিতে যাওয়া শিশুদের জন্য রয়েছে খেলার স্থান। ছবি: নিউজবাংলা
হাসপাতালের জনসংযোগ বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, প্রতিদিন হাসপাতালটিতে প্রায় ৭০০ রোগী বিভিন্ন বিভাগে চোখের যাবতীয় সেবা নিয়ে থাকেন। বছরে ২ লাখের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। বছরব্যাপী রোগীদের সেবা দিতে বিশেষজ্ঞসহ ৫০ জনের চিকিৎসক দল রয়েছে সেখানে। আর প্রতিদিন গড়ে ১০০ রোগীর অস্ত্রোপচার হয়।
এ ছাড়া সেখানে রয়েছে ৯টি আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষে রেটিনা প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে সব ধরনের জটিল অপারেশনের ব্যবস্থা। বছরে প্রায় ৩০ হাজার রোগী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান।
হাসপাতালটিতে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় আউটডোরে চক্ষুসেবার কর্মযজ্ঞ, চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। শনিবার বন্ধ থাকলেও সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে জরুরি বিভাগ। তবে শুক্রবার আউটডোরে সেবা মেলে দুপুর ১২টা অবধি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা প্রতিদিন চোখের বিভিন্ন সমস্য নিয়ে হাজির হন পাহাড়তলীর এই হাসপাতালে। স্বল্প খরচে দেশসেরা চিকিৎসা পান বলেই তারা ছুটে আসেন।
হাসপাতালের শিশু বিভাগে পারভীন আক্তার নামের একজনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার প্রতিবেদকের। নোয়াখালী থেকে মেয়েকে নিয়ে গেছেন তিনি।
পারভীন আক্তার বলেন, ‘দুই মাস আগে খেলতে গিয়ে আমার ৫ বছর বয়সী মেয়ের ডান চোখে আঘাত লাগে। তখন প্রতিবেশীদের পরামর্শে এখানে নিয়ে আসি। চিকিৎসকদের আন্তরিক সেবায় আগের চেয়ে আমার মেয়ের চোখের অবস্থা অনেক ভালো। অল্প টাকায় ভালো চিকিৎসা পেয়েছি এখানে।’
পেশায় কৃষক দবিরুল ইসলাম। বরিশাল থেকে চোখের ছানির চিকিৎসা করাতে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে যান। চিকিৎসকের সাক্ষাৎ শেষে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক চোখে ছানি পড়েছে। অপারেশন করাতে হবে। অন্যখানে যেখানে ২০ হাজার টাকা, এখানে একই অপারেশন ৮-১০ হাজার টাকা। সেবাও ভালো, গরিব মানুষ এ হাসপাতাল থেকে অনেক উপকার পাচ্ছে।’
ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশে ঘেরা হাসপাতালটিতে ১৩টি ব্লকে রয়েছে ১০০টি সাধারণ শয্যা ও ৩৫টি বিভিন্ন ধরনের কেবিন।
এ ছাড়া শিশুদের চোখের ক্যানসার চিকিৎসায় আছে আলাদা বিভাগ। এ পর্যন্ত এখানে চিকিৎসা নিয়ে ৩৮৬ জন শিশুর চোখের ক্যানসার নিরাময় হয়েছে। পাশাপাশি গত এক বছরে অপরিপক্ব বা অপরিপূর্ণ চোখের গঠন নিয়ে জন্মানো ৫০৮টি শিশুও চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়েছে।
পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া লোকজন। ছবি: নিউজবাংলা
এদিকে দেশের চক্ষুসেবা কার্যক্রমের সঙ্গে তাল মেলাতে ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল ব্যক্তির জন্য এখানে ‘হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ চালু করা হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৯১ সালে ‘কমিউনিটি অফথালমোথলজি’ কোর্স চালু করা হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে দুই বছর মেয়াদে ডিপ্লোমা ইন কমিউনিটি অফথালমোলজি (ডিসিও), ৫ বছর মেয়াদের মাস্টার্স অফ অফথালমোলজি, ৪ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অফ সায়েন্স ইন অপটোমেট্রি (বি. অপটাম) ডিগ্রি দেয়া হয়।
হাসপাতালের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭২ সালে এক বিকেলে অন্ধ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সহায়তার জন্য আমরা ছোট্ট উদ্যোগ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। মাত্র ৩ হাজার ৬০০ টাকা ছিল পুঁজি। এখন এই হাসপাতাল দেশের লাখো মানুষের চোখের চিকিৎসায় আস্থার নাম।
‘চার উদ্যোক্তাদের মধ্যে আমিই শুধু বেঁচে আছি। আমাকেও চলে যেতে হবে; কিন্তু যুগযুগ ধরে সেবা দিয়ে যাবে আমাদের সে দিনের সেই ছোট্ট উদ্যোগ।’