ধান, শস্য নিয়ে চিলমারি বন্দরে যায় স্বামী। বাহন তার ধীরগতির গরুর গাড়ি। তাই বন্দরের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই লেগে যায় বেশ কয়েক দিন। মেঠোপথের দিকে চেয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন কাটে না কিষানির।
নারীর এমন আকুলতা নিয়েই আব্বাস উদ্দিন গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান- ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে..।’
সেই গাড়িয়াল ভাইয়ের দেশ রংপুরের সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রাম জেলার মেঠোপথগুলো এখন ইট-পাথর আর পিচঢালা পথে পরিণত হচ্ছে। গরুর গাড়ির চাকার শব্দও ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে এর বদলে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে সেখানে।
শহরের পিচঢালা পথ আর চরাঞ্চলের দুর্গম রাস্তা- দুই জায়গাতেই পণ্য আনা-নেয়ার সহজ মাধ্যম এখন ঘোড়ার গাড়ি।
কৃষি নির্ভরশীল এই জেলায় ভারী কলকারখানা না থাকায় মানুষের কাজ থাকে না বছরের অধিকাংশ সময়। তাই তাদের অনেকের কাছেই স্বল্প ব্যয়ে সারা বছর আয়-রোজগারের উপায় হয়ে উঠেছে ঘোড়ার গাড়ি।
দেখা গেছে, দিনমজুর থেকে শুরু করে রিকশা-ভ্যান চালকরাও এখন ঘোড়ার গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন।
এ ছাড়া গরু বা মহিষের গাড়ি বানাতে খরচ পড়ে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। অলিগলিতে এসব গাড়ি যেতে না পারায় তেমন আয়ও হয় না। অন্যদিকে মাটি কিংবা বালু পথেও ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে চলাচল অনেক সহজ। এই গাড়ি বানাতেও বেশি খরচ পড়ে না। তাই গরু বিক্রি করে বা ঋণ করে হলেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় ঘোড়া কিনে গাড়ি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন অনেকেই।
ঘোড়ার গাড়িচালক আজগর আলী বলেন, ‘হামার চরের মধ্যে সারা বছর কাইমকাজ জোটে না। এনজিও থাকি ঋণ করিয়া ঘোড়ার গাড়ি কচ্ছি। এলা সারা বছর চলে। পরিশ্রম একটু বেশি হলেও বসি থাকা নাগে না।’
- আরও পড়ুন: হাটটি কেবল ঘোড়া কেনাবেচার
সহিদুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ‘গরু বা মহিষের গাড়ি করতে গেলে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। একটা ঘোড়া ৫০ থেকে ৬০ হাজার আর গাড়ি বাইনাতে লাগে ১০ হাজার টাকা। বালু, চিকন, ভাঙ্গা রাস্তা সোগটাই চলে।’
সহিদুল জানান, তার এলাকায়ই ৪০০ থেকে ৫০০ ঘোড়ার গাড়ি আছে। একেকটি গাড়ি থেকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকাও আয় হয়। বিপরীতে ঘাস, ভুসি, খড়সহ ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণে দিনে এক থেকে দেড় শ টাকা খরচ হয়।
চরের খুচরা ব্যবসায়ী তালেব মিয়া জানান, চরাঞ্চলের বালু দিয়ে ভালো করে হাঁটাই যায় না। ভ্যান বা অন্য গাড়িও চলে না। তবে অল্প খরচে ঘোড়ার গাড়িতে সহজেই মালামাল পরিবহন করা যায়।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জব্বার বলেন, ‘আগে তো বাহে গরু বা মহিষের গাড়ি আছিল। হামরা ভার উবাইছি ঘাড়ত করিয়া। এই ১৫-১৬ বছর হইল ঘোড়ার গাড়ি আসিবার। এই গাড়ি হয়া কত মাইনসের যেমন উপকার হইছে, তেমন কর্মসংস্থানও বাচ্ছে।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের সদস্য রহিম আহমেদ রিপন জানান, মাত্র দেড় যুগেই জেলায় কয়েক হাজার ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়েছে। নিম্ন আয়ের অনেক পরিবারের কাছে পরিববেশ বান্ধব এই বাহনটি এখন স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।