কয়েক জেলায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত বৃষ্টি ঝরেছে। এতে তলিয়ে গেছে আলু, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গম, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়ায় বেড়েছে শীতের তীব্রতা।
মাঘের শীতে এমন বৃষ্টি ও ঠান্ডায় বিপর্যস্ত কৃষক। তারা ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
কৃষি বিভাগ আশ্বস্ত করেছে, এই বৃষ্টিতে ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে বৃষ্টি চলতে থাকলে লোকসানের শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে কৃষকদের এখনই নানা পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
ঠাকুরগাঁও
সদরের আকচা ইউনিয়নে শুক্রবার বিভিন্ন ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ঝড়ো বাতাসের তোড়ে আগাম আবাদের গম, সরিষা, ভুট্টাগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। আলুক্ষেতে জমে গেছে বৃষ্টির পানি। শীতের তীব্রতায় ফসলি মাঠে কাজ করতে দেখা যায়নি কোনো শ্রমিককে।
নিউজবাংলাকে কৃষক আতাউর রহমান জানান, এবার তিন বিঘা জমিতে আগাম গমের আবাদ করেছেন তিনি। মাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছিল গম, কিন্তু মধ্যরাতের বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসে তার গমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গমগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে।
আলুচাষি করিম বলেন, ‘সাত বিঘা জমিতে আলু করেছি। আজ আলু তোলার কথা ছিল। বৃষ্টির কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকরা এসে ঘুরে চলে গেলেন।’
দিনমজুর রহমত মিয়া বলেন, ‘আলুর কাজে এসেছিলাম। দেখি আলুক্ষেতে বৃষ্টির পানি জমে গেছে। তাই কাজ বন্ধ। বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে গেছে অনেক বসতবাড়ির টিনের চাল। সেগুলো মেরামত করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
স্থানীয় মানিক তার ক্ষতিগ্রস্ত ঘর ঠিক করছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে এনজিও থেকে লোন নিয়ে টিনের ঘর বানাইলাম। বাতাসে টিন উড়ে গেছে। সেগুলো আবার কুড়িয়ে এনে ঘর মেরামত করছি। আজ আর বাইরে কোনো কাজে যাব না।’
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবু হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাতে ৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, সঙ্গে ছিল দমকা বাতাস। এতে আগাম গমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে, কৃষিকাজও ব্যাহত হয়েছে।
‘কৃষকদের আলুক্ষেতে পানি না শুকানো পর্যন্ত আলু তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। বন্ধ রাখতে হবে সার-কীটনাশক প্রয়োগ। এখন সবচেয়ে জরুরি বৃষ্টির পানি ক্ষেত থেকে বের করার ব্যবস্থা করা।’
নীলফামারী
গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। নিউজবাংলাকে সৈয়দপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হোসেন জানান, আগামীকালও ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
সদরের লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের সহদেব বড়গাছা এলাকার মনোরঞ্জন রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছি। শুক্রবার সকাল থেকে ঝড়ো হাওয়ায় আলুগাছ শুয়ে গেছে।’
একই এলাকার আরেক কৃষক ধীরেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে সরিষা করেছি। আজকের এই আবহাওয়ায় সব শেষ হয়ে গেল।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘এই বৃষ্টিতে কৃষকদের তেমন ক্ষতি হয়নি। যারা আগাম ভুট্টা করেছেন সেগুলো হয়তো লুটিয়ে পড়েছে। তবে আলুগুলো বীজ হিসেবে সংরক্ষণ যাবে না।’
ময়মনসিংহ
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরেছে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। সঙ্গে দমকা হাওয়ায় বেড়েছে ঠান্ডা। টানা বৃষ্টিতে নিচু ফসলি জমিতে পানি জমেছে, তলিয়ে গেছে আলুসহ শীতের বিভিন্ন সবজি। উৎপাদন নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।
নিউজবাংলাকে পরানগঞ্জ গ্রামের কৃষক ছামাদ মিয়া বলেন, ‘৯ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। গত এক সপ্তাহে শ্রমিক নিয়ে চার বিঘা জমি থেকে আলু তুলে বাজারে বিক্রি করেছি। ভেবেছিলাম শুক্রবার পরিবারের সদস্যসহ শ্রমিকের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দুদিনের মধ্যেই সব তুলে বিক্রি করব।
‘তবে আমার জমিগুলো নিচু হওয়ায় সারা দিনের বৃষ্টিতে আলুক্ষেতে পানি জমেছে। এভাবে বৃষ্টি চলতে থাকলে আলু পচে যাবে এবং ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করা একই গ্রামের ফরহাদ মিয়া যেন আরও বেশি চিন্তিত। বলেন, ‘চার বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। এরই মধ্যে গমে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। টানা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলেও কোনো ক্ষতি হয়নি।
‘যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তাতে গম উৎপাদন বাড়বে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হব। কারণ এবার সুদের ওপর ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করছি।’
চরখরিচা গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই দুই বিঘা জমিতে টমেটো, শিম, ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘শীতের মধ্যে বৃষ্টিতে অন্য সবজির ক্ষয়ক্ষতি না হলেও টমেটো নিয়ে চিন্তায় আছি। আগের চেয়ে বাজারে টমেটোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরাও ভালো দাম পাচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টিতে কিছু গাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। আর বৃষ্টি না হলেই আমাদের জন্য ভালো।’
নিউজবাংলাকে ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সোয়েব আহমেদ বলেন, ‘ময়মনসিংহে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। তার পরও যেসব জমি এখনও স্যাঁতস্যাঁতে, সেসব জমিতে চারার গোড়াপচা রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। তবে রোদ হলেই এই সংকট কেটে যাবে। সংকট থেকে গেলে সেই ক্ষেত্রে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
‘যদি কোনো আলুক্ষেতে পানি জমে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি থামলে কিংবা একটু রোদে মাটি শুকালেই কৃষকরা আলু তুললে ভালো হবে।’
বগুড়া
আলু ও সরিষার ফলন তোলার একেবারে শেষ সময় এখন। এই সময়ে বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসে ফসলের উৎপাদন নিয়ে বগুড়ার কৃষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
কৃষকরা বলছেন, কয়েক বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতে আলুসহ সরিষার উৎপাদনের পরিমাণ ও মান দুটোই কমবে।
শিবগঞ্জ উপজেলার খামারপাড়ার কৃষক সুজাউদ্দিন সুমন এবার ছয় বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে তিন বিঘার আলু তুলেছেন। আলু তোলার মূল সময় ছিল এখনই। আর এটা থেকেই বীজ করতেন, কিন্তু বৃষ্টিতে তার আশা নষ্ট হয়ে গেছে।
সুমন বলেন, ‘অন্তত ৩০ বছরের মধ্যে শীতকালে এত বৃষ্টি দেখিনি। আমাদের এখানকার জমি এমনিতেই নিচু। অল্প বৃষ্টি হলে পানি মাটি শুষে নিত। কিন্তু এ পানি দুদিনেও নামবে না।’
‘বৃষ্টির কারণে এসব আলু পচন ধরবে। এগুলো থেকে ভালো বীজও পাওয়া যাবে না।’
এতে অন্তত ২০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।
একই দশা দুপচাঁচিয়ার চামরুল ইউনিয়নের কৃষক রফিকুল ইসলামের। তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সরিষা এবং সাড়ে চার বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেছিলেন। বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের কারণে সরিষা জমিতে শুয়ে পড়েছে। আর আলুগাছের গোড়া পানিতে তলিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এসব জমিতে বোরো ধান সাধারণত হয় না। এ জন্য আমাদের আলু, সরিষা আবাদে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। এখানে জমিতে কাজ করার লোকও পাওয়া যায় না। এ জন্য আবাদে খরচও বেশি হয়। তার ওপর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ফলন কম আসবে।’
শাজাহানপুরের মানিকদীপা বোরো চাষি মোহাম্মদ আলী জানান, এক মাস আগে তিন বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। এই বৃষ্টি পেয়ে ধানের গাছ এখন দ্রুত বাড়বে। কিন্তু একই উপজেলার বামুনিয়া এলাকার আবু জাফর কয়েক দিন আগেই আড়াই শতক জমিতে বোরো ধানের বীজতলা করেছেন। ধারণা করেননি রাতের বেলা বৃষ্টি হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিতে বীজতলা প্রায় ধুয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নুতন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। এতে আমি বোরো আবাদে পিছিয়ে গেলাম।’
এ বৃষ্টিকে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বলে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়াবিদ সজিব হোসাইন। তিনি বলেন, ‘শীতের শেষ দিকে এমন বৃষ্টিপাত হয়। এর স্থায়িত্ব ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আগামীকাল থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
বৃষ্টিপাতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) মুহা. মশিদুল হক বলেন, এই বৃষ্টিপাত আলু ও সরিষার জন্য ক্ষতিকর। এসব ফসল সংগ্রহে অন্তত ১৫ দিন দেরি হবে। এতে বোরো আবাদও পিছিয়ে পড়বে। তবে বোরো আবাদের জন্য বৃষ্টি ভালো। এতে ভূর্গভস্থ পানি সাশ্রয়ী হবে। ধানগাছ দ্রুত বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টি আর না হলে ফসলের উৎপাদনে সমস্যা হবে না। এ ছাড়া আলু, সরিষা, পেঁয়াজের জমিতে পানি নেমে যাওয়ার পর প্রতি লিটারে ২ মিলি করে ছত্রাকনাশক ওষুধ দেয়া যেতে পারে। এতে ফসল পচে যাওয়া রোধ হবে।’
জয়পুরহাট
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে এই জেলায়। পানি জমে ক্ষেতে কাদা হয়েছে। পচে যাওয়া এড়াতে তড়িঘড়ি করে ক্ষেত থেকে আলু তুলেছেন কৃষকরা। তবে হিমাগার না পাওয়ায় সেগুলো সংরক্ষণও করতে পারছেন না তারা। এ কারণে আলু কম দামে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে বলে জানালেন তারা।
ক্ষেতলাল উপজেলার বড়ই গ্রামের কৃষক সাদেক হোসেন ছয় বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জমিতে বৃষ্টির পানি জমে গেছে। দ্রুত আলু ওঠানোর চেষ্টা করছি। বৃষ্টির পানির কারণে ৫০ শতাংশ আলু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বছর আলুর দাম কম এবং এই অসময়ে বৃষ্টির পানি হওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হলাম।’
একই ইউনিয়নের সাগরপুর গ্রামের নূর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে অনেক আলু উৎপাদন হয়, কিন্তু তা সংরক্ষণ করার এখনও সময় হয়নি। বৃষ্টির কারণে আলু দ্রুত জমি থেকে ওঠাতে হচ্ছে। সংরক্ষণ করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।’
সদরের গৌরীপাড়া গ্রামের কৃষক বাবু মণ্ডল বলেন, ‘আমি ঋণ করে জমিতে আলু লাগিয়েছিলাম। আলু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করব, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। জমিতে পানি জমেছে, দ্রুত আলু ওঠাতে হচ্ছে। তাই কম দামেই আলু বিক্রি করতে হচ্ছে।’
নিউজবাংলাকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রার অধিক জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর ফলনও ভালো হয়েছে। তবে শুক্রবার ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে আলুর জমিতে পানি জমে গেছে। এতে আলু পচে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
ক্ষতি কমাতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি এম এস রানা, নীলফামারীর নূর আলম, ময়মনসিংহের কাম্রুজ্জামান মিন্টু, বগুড়ার আসাফ-উদ-দৌলা নিয়ন