আব্রাহাম লিংকন। নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্মৃতিতে ভাসে সুদূর মার্কিন এক নাগরিকের কথা, যিনি গণতন্ত্রের জনক নামে পরিচিত।
তবে এ বছর হাজার হাজার মাইল দূরের নয়, বাংলার মাটিতে অন্য এক আব্রাহাম লিংকনকে স্বীকৃতি দেয়া হলো। সমাজসেবায় অনন্য অবদান রাখতে একুশে পদকের জন্য মনোনীত হলেন কুড়িগ্রামের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করে তারা। সেই তালিকার ১৭ নম্বরে রয়েছে এস এম আব্রাহাম লিংকনের নাম।
কুড়িগ্রামের কৃতি সন্তান হিসেবে একুশে পদক পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন আব্রাহাম লিংকন। এর আগে সেখানে জন্ম নেয়া সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক প্রথম একুশে পদক পান।
বরেণ্য এ ব্যক্তিকে একুশে পদকে মনোনীত করায় খুশি কুড়িগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। বৃহস্পতিবার এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তার বাসভবন লিংকন ইনসে ভিড় জমান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এস এম আব্রাহাম লিংকন একাধারে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, আইনজীবী, লেখক, কলামিস্ট ও শিক্ষক। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, কুড়িগ্রাম আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, পাবলিক প্রসিকিউটর এবং সমাজকর্মী।
কুড়িগ্রাম পৌরসভার নাজিরা ব্যাপারী পাড়ায় ১৯৬৬ সালের ১৪ নভেম্বর জন্ম হয় অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকনের। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন ব্যাপারী। ৭ ভাই ১ বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। তার স্ত্রী অধ্যাপক শামসুন নাহার বেগম সুইটি কলেজে শিক্ষকতা করেন এবং একমাত্র সন্তান সিদ্ধার্থ অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা করছেন।
এস এম আব্রাহাম লিংকন একাধারে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, আইনজীবী, লেখক, কলামিস্ট ও শিক্ষক। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, কুড়িগ্রাম আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, পাবলিক প্রসিকিউটর এবং সমাজকর্মী।
তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষক। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে প্রণীত মুক্তিযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে তিনি লেখেন ১৫টি গ্রন্থ।
তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে, ১৯৭১: ইপিআরের সেইসব যোদ্ধাগণ, উত্তর রণাঙ্গনে সংখ্যালঘু গণহত্যা ও নারী নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস: রংপুর, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস কুড়িগ্রাম জেলা, আইন আদালতের বিকাশ।
তার লেখা কাব্যগ্রন্থ, ভাওয়াইয়ার স্বরে বঙ্গবন্ধু, জলেশ্বরীর ভূমিপুত্র, শেষ যুদ্ধের ডাক দিয়ে যাই। তিনি সম্পাদনা করেছেন একাত্তরের অগ্রদূত, শামসুন নাহার চৌধুরী: জীবন মৃত্যুর মাঝখানে। এ ছাড়া রঙ্গপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষসহ অনেক গ্রন্থ লিখেছেন।
আব্রাহাম লিংকন নিজেকে ছিটমহলবাসীদের নানা দাবির আন্দোলনেও নিয়োজিত করেন। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনে তিনি উভয় দেশের সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা হন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময়ের দিন বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের মশালডাঙ্গায় অনুষ্ঠিত মূল সভায় অংশ নেন।
শৈশব থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত আব্রাহাম লিংকন। কখনও মৌলবাদবিরোধী, কখনও আবার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে জেলও খেটেছেন। ছাত্রাবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসুর এজিএস ও সিনেটে সর্বোচ্চ ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
ছাত্রজীবন শেষে কুড়িগ্রামে এসে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯২ সালে কুড়িগ্রাম আইন কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এ কলেজেই তিনি তিন দশক ধরে অধ্যক্ষ পদে রয়েছেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ত্রিশ বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে দেশে ইতিহাস গড়েছেন কুড়িগ্রামের আব্রাহাম।
সীমান্তে আলোচিত ফেলানী হত্যা মামলায় আইনজীবী হিসেবে আন্তর্জাতিক বিবেককে জাগ্রত করেন এস এম আব্রাহাম লিংকন। ফেলানী হত্যার বিচারের দাবিতে লড়ে যাচ্ছেন এখনও।
বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিক যারা পারাপার হতে গিয়ে জেলখানায় আটক হন, তাদের আইনি সহযোগিতার জন্য গড়ে তুলেছেন বর্ডার ভিকটিমস রেসকিউ লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স ফোরাম। এটির বাংলাদেশ অংশের প্রধান তিনি আর ভারতের প্রধান প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠক কিরীটী রায়।
আব্রাহাম লিংকন নিজেকে ছিটমহলবাসীদের নানা দাবির আন্দোলনেও নিয়োজিত করেন। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনে তিনি উভয় দেশের সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা হন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময়ের দিন বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের মশালডাঙ্গায় অনুষ্ঠিত মূল সভায় অংশ নেন।
বিনিময়ের পর একটি নির্ভুল তালিকা ও জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি তালিকা করে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ‘ছিটমহলে সংগ্রাম ও মুক্তি’ নামে তার একটি গ্রন্থও রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ২০১২ সালে নিজের বাড়িতেই গড়ে তোলেন উত্তরবঙ্গ জাদুঘর। সেখানে খেতাবপ্রাপ্ত ও খেতাবহীন মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী, যুদ্ধে ব্যবহৃত গুলি, গ্রেনেডের বাক্স, যুদ্ধকালীন কুড়িগ্রাম-ভারত ব্যাংকিং যোগাযোগের দলিলপত্র ও জ্বালিয়ে দেয়া ঘরবাড়ির তালিকাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিসহ ৫ হাজার ৮৬৫ জন রাজাকারের তালিকাও রয়েছে।
ছাত্রজীবন শেষে কুড়িগ্রামে এসে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯২ সালে কুড়িগ্রাম আইন কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এ কলেজেই তিনি তিন দশক ধরে অধ্যক্ষ পদে রয়েছেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ত্রিশ বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে দেশে ইতিহাস গড়েছেন কুড়িগ্রামের আব্রাহাম।
এখানেই সংরক্ষিত আছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কফিনসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে জাদুঘরটি। দিনে দিনে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের দুর্লভ স্মারকে সমৃদ্ধ হচ্ছে বৃহত্তর রংপুরের অন্যতম বাতিঘর উত্তরবঙ্গ জাদুঘর।
এখানে ছুটে এসেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, বিচারপতি, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা ও গবেষকরা। নিজের দানকৃত ১৮ শতক জমিতে বর্তমানে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে জাদুঘরের নতুন চার তলা ভবন।
একুশে পদকে মনোনয়নের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আব্রাহাম লিংকন নিউজবাংলাকে জানান, মুক্তিযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। বিচারকমণ্ডলীকে ধন্যবাদ, তারা তৃণমূলে তাকিয়ে কাজের মূল্যায়ন করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এই সম্মান আমাকে দেশ ও সমাজের জন্য আরও বেশি কাজ করতে দায়বদ্ধ করল।’
পদকের অর্থ নতুন প্রজন্মের ইতিহাস অনুসন্ধানের স্বার্থে উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে দান করবেন বলে জানান কুড়িগ্রামের আব্রাহাম লিংকন।