ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করা ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের শেষ দিনগুলো কাটছিল নিঃসঙ্গতায়। ফেসবুক লাইভে তিনি তার একাকিত্বের কথা জানিয়েছেন। তাকে যারা দেখেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, সচ্ছলতার অভাব না থাকলেও বন্ধুপরিজনহীন জীবন কাটছিল তার।
ধানমন্ডি সাত নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাসায় ১২ তলা একটি ভবনের ছয় তলায় থাকতেন আবু মহসিন খান। ভবনের ম্যানেজার আব্দুর রহিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছয় মাস ধরে এখানে আছি। এই বাসাটা স্যারের (মহসিন) নিজের কেনা ফ্ল্যাট। আমি গত ছয় মাসের কথা বলতে পারি। তিনি একাই থাকতেন এই বাসায়। স্যার বাসার সবকিছু একাই হ্যান্ডেল করতেন। কাউকে তার বাসায় যেতে দেখা যায়নি।’
ছয় তলায় ফাইভ-এ ফ্ল্যাটটি এখন ফাঁকা। মৃত্যুর এক দিন পর বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় গৃহকর্মীরা বাসাটির ধুলা পরিষ্কার করছেন। ভবনের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ‘আমি প্রায় তিন বছর ধরে এই বাড়ির সিঁড়ি মুছি। গত তিন বছর ধরে দেখতেছি তিনি একাই থাকেন এই বাসায়। আমি তো ভেতরে যাইতাম না। তাই বলতে পারব না, ভেতরে কী হতো।’
বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে আত্মীয়স্বজন মহসিনকে শেষবারের মতো দেখতে আসা শুরু করেন। তবে তার আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা হাতে গোনা। ৮২ বছর বয়সী মহসিনের বাবা তাকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে দেখা যায় তার ছোট দুই ভাইকেও।
মহসিনের একাকী চলাচল
ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে হাঁটতে বেরোতেন। একাই যেতেন জুতায় কালি করাতে, খাবার কিনতে।
২৫ নম্বর ভবনের বিপরীত পাশের একটি চায়ের দোকানি মো. রতন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি একা একা বের হয়ে মুদি কেনাকাটা করতেন। জুতা কালি করতে আসতেন। সঙ্গে কাউকে দেখি নাই কোনো দিন। মাঝে মাঝে বাসার সামনে দিয়ে একাই ঘুরে বেড়াতেন।’
চায়ের দোকানের পাশেই ফুটপাতে বসেন মুচি রণজিত। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্যার আমার কাছে জুতা কালি করাতে আসতেন। দেখতাম মাঝে মাঝে বাইরে একা একা ঘোরাফেরা করতেন।’
নাম প্রকাশ না করে মহসিনের পাশের ফ্ল্যাটের এক প্রতিবেশী নারী জানান, আসা-যাওয়ার পথে তার সঙ্গে দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো। তাকে দেখে তার কখনও মনে হয়নি, আত্মহত্যা করার মতো বিষণ্নতায় ভুগছেন।
ভবনের কয়েকজন চালক জানান, মহসিন সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। চালক রানা নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন। সবার সাথে হাসিখুশি মুখে কথা বলতেন। বাসায় কেউ থাকত না তার সঙ্গে। মাঝে মাঝে তার ভাইয়ের বাসা থেকে খাবার আসত। তিনি একা একা গাড়ি চালিয়ে খাবার আনতেন। অসুস্থ থাকলে খাবার অর্ডার দিয়ে আনাতেন। একটা ছেলে মাঝে মাঝে এসে তার গাড়ি ধুয়ে দিত। বাসা পরিষ্কার করে দিত।’
ধানমন্ডির এই ভবনের একটি ফ্ল্যাটেই থাকতেন আবু মহসিন খান। ছবি: নিউজবাংলারানা বলেন, ‘চালকদের জন্য এই ভবনে আলাদা লিফট। তবে তিনি লিফটে উঠলে আমাদের তার লিফটে ওঠাতেন।’
মহসিন খানের জামাতা চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, ‘আমরাই খাবার পাঠাতাম। এ ছাড়া তিনি বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে আনতেন। কতদিন আগে থেকে ক্যানসার সেটা মনে করতে পারছি না। তবে বছর দুয়েক আগে তার অপারেশন করা হয় ক্যানসারের। আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য অনেকবার বলেছি। তবে তিনি থাকেননি।’
মহসিন খানের ছোট ভাই আবু হাসান মো. ওয়াহিদুজ্জামান লিপু বলেন, ‘ওনার একাকিত্ব ওনাকে খেয়ে ফেলেছে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। একটা মানুষ তিন থেকে চার বছর একটা ফ্ল্যাটে একা থাকেন। তার ওয়াইফ, ছেলে দেশের বাইরে। উনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। ওনার অপারেশনও হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কারণ উনি দেশের বাইরেই বেশি ছিলেন। আপনার সঙ্গে আমার গ্যাপ থাকলে আপনার কিছুই আমি জানতে পারব না। ওনার সঙ্গে আমাদের আট বছরের একটা গ্যাপ ছিল। মাঝে মধ্যে কথা হতো, কিন্তু ওরকম যে সবকিছু শেয়ার করবে, সে সুযোগ ছিল না। গ্যাপ হয়ে গেলে শেয়ার করার অবস্থাটা থাকে না।
‘ওনার ক্লোজ ছিল ওনার ছেলেমেয়ে। মেয়ের হাজবেন্ড কতটা ক্লোজ ছিল, আমি জানি না। মেয়ের হাজবেন্ডের সঙ্গে তো আর এত কিছু শেয়ার করা যাবে না। আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে যেভাবে সবকিছু শেয়ার করতে পারবেন, অন্যদের সঙ্গে পারবেন না। বাবাও বেঁচে আছেন। বাবা স্ট্রোক করা রোগী। ওনাকে ঘটনা জানানোর আগে প্রেশার, সুগার লেভেল মেপে জানাতে হয়েছে। ওনাকে জানানোটাই অনেক কষ্ট হয়েছে।’
আবু মহসিন খানের মৃত্যুর পর তার ফ্ল্যাটে মেয়েজামাই চিত্রনায়ক রিয়াজ। ছবি: নিউজবাংলাআবু হাসান মো. ওয়াহিদুজ্জামান লিপু জানান, ক্যানসারের কারণে মহসিন খানের একটি কিডনি অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এ অস্ত্রোপচার হয়।
কী ধরনের ক্যানসার ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী ক্যানসার ছিল সেটা আমি বলতে পারব না। আমি কিছুই জানি না।’
মহসিন খান তার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লিপু বলেন, ‘তার ব্যবসা কীভাবে বন্ধ হয়ে গেল, এটা আমি বলতে পারব না। কারণ ওনার সঙ্গে আট বছরের গ্যাপ। উনি কোথায় ব্যবসা করতেন, কীভাবে করতেন, কিছুই জানি না।’
আট বছরের যোগাযোগহীনতা কীভাবে তৈরি হলো, জানতে চাইলে লিপু বলেন, ‘উনি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে ছিলেন। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া। এখন আপনি যদি দেশের বাইরে থাকেন, তাহলে আপনার সঙ্গে আমার তো যোগাযোগটা থাকবে না। উনি তিন বছর থাকতেন বিদেশে, এর পর দেশে ১০ দিন থাকতেন, আবার চলে যেতেন।’
শেষ চার বছর দেশেই ছিলেন মহসিন
শেষ চার বছর মহসিন খান দেশে ছিলেন জানিয়ে লিপু বলেন, ‘ওনার ছেলে আর ওয়াইফ তিন-চার বছর আগে শেষ দেশে এসেছিলেন। তারা অস্ট্রেলিয়া থাকেন। উনি স্বাধীনচেতা মানুষ তো, বাসাতেই থাকতেন। আমরা দূর থেকে যতটুকু সাপোর্ট দিতে পেরেছি, দিয়েছি। খাবার-দাবার রান্না করে দিয়ে যাওয়া এতটুকু আমরা করতে পেরেছি। এই ফ্ল্যাটটা ওনার নিজের। উনি অন্য কোথাও থাকতেই চাইতেন না। ওনার মোহাম্মদপুরেও ফ্ল্যাট আছে, কলাবাগানেও আছে।’
তৈরি পোশাক মহসিন খানের পারিবারিক ব্যবসা। তার বাবা ১৯৮২ সাল থেকে দুটি পোশাক কারখানার মালিক। মহসিন খান পরে উনি পৃথক ব্যবসা শুরু করেন।
বুধবার রাত ৯টার দিকে নিজ ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে এসে মহসিন খান মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তার আগে তিনি তার নিঃসঙ্গতা, পরিবার নিয়ে হতাশার কথা জানান। এক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে দুঃখও প্রকাশ করেন তিনি।