ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করা ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান মৃত্যুর আগে তার একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনের কথা জানিয়েছেন। একসময়ে সফল ব্যবসায়ী ছিলেন জানিয়ে তিনি পরিবার-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গও তোলেন ফেসবুক লাইভে।
বাবা হিসেবে দায়িত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে, ফ্যামিলিকে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফ্যামিলি অনেক সময় বুঝতে চায় না। নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না।’
মহসিন খানের নিঃসঙ্গ জীবনের পেছনে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সংকটকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, প্রচলিত ধারণায় পুরুষকে শক্তিমান ও ক্ষমতাধর হিসেবে দেখা হলেও পুরুষকেও বহুমুখী চাপের শিকার হতে হয়। স্বাভাবিক সক্রিয় জীবনের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে তীব্র একাকিত্বের মুখোমুখি হন অসংখ্য পুরুষ।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের ভরণ-পোষণের মূল চাপটি বহন করে পুরুষ। তবে এটি পুরুষের সহজাত কোনো প্রবৃত্তি নয়। আর অব্যাহত এই দায়িত্বের বোঝা কখনও কখনও পুরুষকে করে তোলে অসহায়। প্রচলিত ধারণায় ‘ইস্পাত দৃঢ়’ পুরুষ শিথিল সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা এবং কর্মহীনতার কারণে ভুগতে পারেন তীব্র বিষণ্ণতায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পুরুষকেই কিন্তু একটা বিশাল নির্যাতনের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেটা পুরুষ নিজেই বুঝতে পারছে না। এর কারণ, তার মধ্যে সব সময় কাজ করে, তাকে আয় করতে হবে, তাকে খরচ করতে হবে। আয়ের জায়গাটা যেন পুরুষের জন্য বরাদ্দ।’
ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়া, কাছের মানুষের কাছে টাকা দিয়ে ঠকে যাওয়ার বিষয়গুলো উঠে এসেছে মহসিন খানের লাইভে।
এ প্রসঙ্গে তানিয়া হক বলেন, ‘সে যখন আয় করতে পারছেন না, তখন পুরুষতান্ত্রিক ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে। আমার তো আয় করার কথা ছিল, আমার তো মার্কেট থেকে টাকা তোলার কথা ছিল, আমার তো হাতে টাকা থাকার কথা ছিল– তিনটা জায়গা তাকে ওভারলোডেড করে ফেলে, বার্ডেন করে ফেলে।’
নিজের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ নেয়ার পাশাপাশি পুরুষের ভঙ্গুর অবস্থার জন্য আধুনিক ব্যস্ত জীবনকেও দায়ী করেছেন এই জেন্ডার বিশ্লেষক।
ড. তানিয়া হক বলেন, ‘আমাদের কারও কোনো সময় নেই। বেঁচে থাকার লড়াই, নগরজীবনের ব্যস্ততায় আমাদের আসলে পরিবারের সবার খোঁজখবর নেয়ার সুযোগটা অনেক কমে গেছে। নগরজীবন সে সুযোগটা যেমন কমিয়ে দিয়েছে, কোভিডের কারণে সেটা আরও অনেকখানি কমে গেছে। ফলে সামাজিক বন্ধন পারিবারিক বন্ধন এগুলো আর তেমনভাবে ক্রিয়াশীল থাকছে না।’
সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা কোভিডের কারণে আরও বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে পিতৃতন্ত্র, এটা রিয়েলাইজ করতে হবে পুরুষ এবং নারী উভয়কে। এটা শুধু নারীর করলে হবে না। পুরুষের বোঝা উচিত, পিতৃতন্ত্রের সাইড এফেক্ট তাকেও পোহাতে হয়।
‘এই যে কেবল দায়িত্ব, দায়িত্ব আর দায়িত্ব- এর মধ্যে কোন দায়িত্বটা পুরুষের ওপর? সার্বিকভাবে আয়ের দায়িত্বটা পুরুষের ওপর। যদিও শহরে গ্রামে সবখানেই নারীরাও উপার্জন করছেন। তবে নারীরা এখানে অনেক বেশি রিলাক্সড, তাদের কাজ না করলেও হয়। কিন্তু পুরুষরা যেন বাধ্য তাদের আয় করতে হবে, এই বাধ্যবাধকতা কবে শেষ হবে?’
তানিয়া হক বলেন, ‘যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করলেন আমরা তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জানি না, আমরা কখনও জানতে চাইও না। আমার কাছে মনে হয়, এ রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো অ্যানালাইসিস হওয়া উচিত। আমাদের রিথিঙ্ক করার সময় এসেছে।’
তবে আত্মহত্যা যেকোনো সমাজে হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি মানুষের অধিকারকেন্দ্রিক অনেক দেশে এটা এখন অধিকারের পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসে আমরা আত্মহত্যা মানতে পারি না কেন? কারণ, আমাদের জীবনব্যবস্থা হলো সামষ্টিক। সম্পর্ক, বন্ধনের ভিত্তিতে পরিবারকেন্দ্রিক আবহে থাকতে আমরা পছন্দ করি বা থাকিও।’
তৌহিদুল হকের মতে, একটি পরিবারে নারী ও পুরুষের ভূমিকা কেমন হবে, তা তৈরি হয়েছে অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আর এখানেই সমস্যা দেখছেন তিনি।
এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা পুরুষকে দেখি তিনি কঠিন একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি টলবেন না। মানসিকভাবে কাবু হবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিষয়গুলো কোনো সহজাত বিষয় না। এগুলো চাপিয়ে দেয়া বিষয়।
‘যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সমাজ দেখি, সমাজকে পরিচালিত করছি এবং নিজেরা বড় হচ্ছি, সেখানে বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং আবেগের চর্চার বড় একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। আর এটিই আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল কারণ।’
তৌহিদ বলেন, ‘আমরা অন্যজনকে যেভাবে বিচার করছি, সেই বিচার করার মধ্যে একটা দূরত্ব রয়ে গেছে, একটা বৈষম্য রয়ে গেছে। ফলে অন্যের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে আমরা বড় করে দেখছি না।’
একজন ব্যক্তির জীবনের দুটো অবস্থানে সহযোগিতার প্রয়োজন হয় বলে মনে করেন এই সমাজ বিশ্লেষক। তার মতে, ‘একজন ব্যক্তির শৈশব এবং প্রবীণ জীবনে অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এ সময় মানুষ অসহায় বোধ করেন।’
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে পুরুষের এই ভঙ্গুর বা অসহায় অবস্থার জন্য শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রচলিত ধারণাকে এককভাবে দায় দিতে চান না মনোবিদ ড. মাহফুজা খানম। সামাজিক মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তনকেও এর জন্য দায়ী করছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘এটার জন্য শুধু যে পুরুষতান্ত্রিক কালচারকে দায়ী করা যাবে, তা কিন্তু নয়। আমাদের সমাজের যে ভ্যালুস (মূল্যবোধ) সেটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দ্রুত বদলের অন্যতম কারণ হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাইরের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এগুলো দ্বারা আমরা ভীষণভাবে প্রভাবিতও হচ্ছি।’
পুরুষ এবং নারী- উভয়ই কর্মমুখী হয়ে পড়ায়, পারিবারিক বন্ধন কিছুটা আলগা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই মনোবিদ। তার মতে, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে দৃঢ় করতে করতে হবে। বাচ্চা-কাচ্চার ফিজিক্যাল নিডের সঙ্গে সাইকোলোজিক্যাল নিডও পূরণ করতে হবে। আনন্দপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে থাকলে স্ট্রেস অনেকটা কমে আসে।’
জীবনের প্রয়োজনের শারীরিক দূরত্ব বাড়লেও পারিবারিক বন্ধন মজবুত রাখার ওপর জোর দেন মাহফুজা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবসায় ধস নামা, পরিবার থেকে মেন্টাল সাপোর্ট না পাওয়ার কারণে সেল্ফ ইস্টিম লো হয়ে যায়। ব্যবসায়ী মহসিনের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে।’
জাপানে এমন ঘটনার নজির আছে জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ‘কাছের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা যাতে না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারী পুরুষকে আলাদা দৃষ্টিতে না দেখে, সবার মনের যত্ন নিতে হবে। আত্মহত্যার প্রধান কারণ ডিপ্রেশন। যত আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়, তার ৯০ শতাংশ হয় মানসিক রোগের কারণে। মনের চিকিৎসাটা করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’
এই চিকিৎসকের পরামর্শ, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।
গবেষণা বলছে, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের বেশিরভাগই পুরুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুরুষের চাপা স্বভাবই এর মূল কারণ।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলিয়া নাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারীর তুলনায় একজন পুরুষ বেশি মানসিক চাপ নেন। স্ট্রেস নেয়ার কারণে অসংক্রামক রোগে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া কাজের প্রয়োজনে বেশিরভাগ সময়ে পুরুষ ঘরের বাইরে থাকেন। পরিবেশ কিংবা বায়ুদূষণ এবং বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবারগ্রহণও এর জন্য দায়ী।’