গত বছরের শেষ প্রান্তিকে কমতে থাকা প্রবাসী আয় নতুন বছরে আবার ঊর্ধ্বমুখী। এ বিষয়টির পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে ঊর্ধ্বগতিও অব্যাহত আছে।
নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। বর্তমান বিনিময় হার (৮৬ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪১ হাজার ৭১৩ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা।
২০২১ সালের জানুয়ারির তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে এই জানুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেশি এসেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই আয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; আগের মাস ডিসেম্বরে একটু বেশি ৪৯০ কোটি ৭৭ লাখ (৪.৯০ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল।
শুধু তৈরি পোশাক নয়, প্রায় সব খাতের আশার আলো জাগিয়ে ২০২১ সাল শুরু হয়েছে।
আর সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) হিসাবে ২৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন (২ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৯ লাখ) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় প্রায় প্রতি বছরই বাড়ে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারে কমই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনার মধ্যেও দারুণ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি যতটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে আয় করছে দেশ।
সাত মাসের রপ্তানি আয় এবার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক ছাড়াও কৃষি প্রক্রিয়াজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ও হস্তশিল্প রপ্তানি বেড়েছে। ফলে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে সাড়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩০.৩০ শতাংশ
এই সাত মাসে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৫৩ লাখ (প্রায় ২৪ বিলিয়ন) ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।
মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮১ দশমিক ১৭ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৭১ কোটি ১২ লাখ ডলার। আয় বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ২১ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
এ ছাড়া জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য, ৮৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৬৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ৬৯ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। ওষুধ রপ্তানি থেকে এসেছে ১১ কোটি ৭১ লাখ ডলার।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।
২০২২ সালজুড়েই এই উল্লম্ফন থাকবে
২০২২ সালজুড়েই রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফন অব্যাহত থাকবে বলে আশা কথা শুনিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান (রপ্তানি) নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই আমরা খুশি। এত দ্রুত করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা ঘুরে দাঁড়াব, ভাবতে পারিনি।’
‘করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে ভয় কেটে গেছে। করোনাকে সঙ্গে নিয়েই সব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় ফের লকডাউনের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেটা নেই। নতুন বাজারেও রপ্তানি বাড়ছে। তাই সার্বিকভাবে বলা যায়, রপ্তানি আয়ের এই ইতিবাচক ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা নতুন বছর শুরু করলাম। প্রচুর অর্ডার আছে; নতুন অর্ডার আসছে। দামও ভালো পাচ্ছি। ২০২২ সালটা উল্লম্ফনের মধ্য দিয়েই যাবে বলে আমরা আশা করছি।’
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এখন রপ্তানি খাত। সত্যিই অবাক করার মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে এই খাতে। এই যে করোনার ধকল সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে রপ্তানি আয়।’
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
সার্বিক রপ্তানি পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা হবে একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের ৫০ বছরের বড় অর্জন।’
এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহে ফের গতি ফিরছে। ডিসেম্বরের পর জানুয়ারিতেও তা বেড়েছে। টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ (১.৭০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই প্রবাসী আয় চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।