একতলা পাকা বাড়ি। ছাদে শিশুর খেলনা আর ফুলের টবের সারি। বাড়ির ভেতরে চারটি কক্ষের দুটিতে খাট, আলমারি, শোকেস, ওভার ড্রয়ারের সঙ্গে আছে সোফা, টিভি রাখার টেবিল ও আলনাসহ অনেক আসবাবপত্র।
প্রবেশমুখে রয়েছে জুতো রাখার ঝুড়ি। রান্নাঘরেও সাজিয়ে রাখা হয়েছে ছোট ছোট অসংখ্য ঝুড়ি। রয়েছে বসার পিড়ি, মোড়া, চেয়ারসহ নানা আসবাব। তার মধ্যে খাট, আলমারি, শোকেস, ওভার ড্রয়ার কাঠের তৈরি হলেও বাকিগুলো একটু ভিন্ন।
ভিন্ন বলতে এগুলো কাগজের তৈরি আসবাব।
রঙ তুলিতে সাজিয়ে তোলা কাগজের টব। ছবি: নিউজবাংলা
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের দারোগাবাড়ি এলাকায় মলিন বিশ্বাস ও শিল্পী বিশ্বাসের ঘরের ছাদে নজরে পড়ে নজরকাড়া এসব আসবাব।
তবে মিলন বিশ্বাস এর সবটুকু কৃতিত্ব দেন তার স্ত্রী শিল্পীর ওপর।
শিল্পীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় নিউজবাংলার প্রতিবেদকের।
শুরুর দিকের কথা:
শিল্পী বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সেনাসদস্য। তার চাকরির সুবাদে ২০০৭ সালে আমরা চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ আবাসিকের বাসিন্দা ছিলাম। সে সময় স্বামীর এক সহকর্মীর স্ত্রীর কাছ থেকে এ কাজ শিখেছি। সেই থেকে ফেলনা কাগজ কুড়িয়ে মণ্ড বানিয়ে শিশুদের খেলনা ও ফুলের টব বানানো শুরু করি। এরপর মোড়া, পিড়ি, ঝুড়ি তৈরি করা শিখি।
মণ্ড তৈরী হয় যেভাবে:
সাদা বা রঙিন সবরকমের কাগজ দিয়ে মণ্ড বানানো যায়। কাগজ টুকরো টুকরো করে একটি পাত্রে পানি দিয়ে প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টা ভিজিয়ে নরম করে নেয়া হয়। এরপর পাথরে থেতলিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়।
মণ্ডের সঙ্গে ভাতের মাড় মিশিয়ে আঁঠার মত করে নেয়া হয়। পোকা বা ইঁদুর যেন ক্ষতি না করে সে জন্য মণ্ডের সঙ্গে তুঁতও মেশানো হয়। এরপর থেকে শুরু হয় হরেক রকম আসবাব তৈরির কাজ।
যেভাবে তৈরি হয় আসবাব:
শিল্পী জানান, আসবাবের আকৃতি অনুযায়ী মণ্ড দিয়ে প্রথমে শক্ত তলানি করা হয়। এরপর রোদে শুকিয়ে শক্ত হলে মণ্ড দিয়ে পুরো আসবাবটি তৈরি করা হয়। তবে কোনো আসবাব একবারে তৈরি সম্ভব নয়। মণ্ডের ওপর মণ্ড লাগানোর সময় ঢলে পড়ার আগে রোদে শুকিয়ে শক্ত করে নিতে হয়।
তিনি জানান, প্রতিটি উপকরণ বানাতে কমপক্ষে ৬ থেকে ৭দিন সময় লাগে। একটি উপকরণ তৈরীর জন্য বসে থাকলে সময়ের সাথে মণ্ডও নষ্ট হবে। এ জন্য একসঙ্গে কয়েকটি উপকরণ বানানোর কাজ শুরু করা হয়। এভাবে প্রতি সপ্তাহেই কয়েকটি গৃহসামগ্রী তৈরি করা সম্ভব হয়।
শিল্পী জানান, প্রতি কেজি কাগজের মণ্ড দিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দামের বড় আকৃতির একটি ফুলের টব, ৬০ কেজি কাগজ দিয়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দামের একসেট সোফা, ৮ কেজি কাগজ দিয়ে ২-৩ হাজার টাকা দামের একটি টেবিল, ২ কেজি কাগজ দিয়ে ৬০০ টাকা দামের একটি মোড়া তৈরি করা সম্ভব। খরচ হয় বিক্রয়মূল্যের ১০ ভাগের এক ভাগ। মূলত পরিশ্রমই এখানে মূল বিনিয়োগ।
রোদে শুকিয়ে নেয়ার পালা:
কাগজের এ কারিগর জানান, উপকরণ তৈরির পরও ৪ থেকে ৫দিন রোদে শুকাতে হয়। রোদে যতই শুকিয়ে নেয়া যায় উপকরণটি ততই শক্ত হয়, যা মাটিতে আছড়ে পড়লেও ভাঙে না। কোন দাগও পড়ে না। তবে উপকরণ তৈরির সময় রোদে শুকানোর কাজ সহজ হলেও একসঙ্গে অনেকগুলো উপকরণ রোদে শুকানো সহজ নয়।
তার স্বামী এ কাজে তাকে সাহায্য করেন।
রং দিয়ে সাজিয়ে তোলা:
রোদে শুকিয়ে শক্ত হলে উপকরণটি পাথর আর সিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে তেলতেলে করে নেওয়া হয়। যার ওপর রং-তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ফুল, পাখিসহ বর্ণিল সাজে সাজিয়ে তোলা হয় প্রতিটি আসবাব। যত বেশি সুন্দর ছবি আঁকা যায় উপকরণটির চাহিদা বাজারে তত বেশি।
সতর্কতা:
শিল্পী জানান, কাগজের মণ্ডের এ আসবাব সহজে ভাঙে না, মচকে না, দাগও পড়ে না। তবে সামান্য পানিতে নিমিষেই গলতে শুরু করে। তাই উপকরণটি রক্ষায় পানি থেকে সাবধান থাকতে হবে।
বর্ষাকালেও বাতাস থেকে যাতে পানি শোষণ করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে হয়। এ কারণে বর্ষাকালে এসব আসবাব তৈরি বন্ধ রাখতে হয়।
দিন বদলের কাহিনী:
শিল্পী বিশ্বাস বলেন, ‘কাগজ দিয়ে আসবাব বানিয়ে আমি নিজের ভাগ্যবদল করতে পেরেছি। শুরুর দিকে শখের বশে এ কাজ করলেও পরে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু করি। আসবাব বিক্রির আয় থেকে স্বামীর বসত ভিটায় এক তলা পাকা বাড়ি করেছি।’
স্বামী মলিন বিশ্বাস বলেন, ‘শিল্পীর তৈরি প্রায় দুই-আড়াই লাখ টাকার আসবাব বিক্রি করা হয় প্রতি বছর। বর্তমানে প্রায় তিন লাখ টাকার আসবাব তৈরি আছে। সংসারের কাজের পাশাপাশি শিল্পী এ কাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এসব সামগ্রী কিনে নিয়ে যান।’
কাগজের মণ্ড দিয়ে আসবাব তৈরির কাজ চলছে। ছবি: নিউজবাংলা
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শহরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের তন্ময় গিফট ফ্যাশনের মালিক নির্ঝর দাশের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘কাগজের তৈরি আসবাব ও শিশুদের খেলনা কাঠ বা যেকোন ধাতব পদার্থের তৈরি উপকরণের চেয়েও সুন্দর। দামও কম। ফলে চাহিদাও বেশি। তবে সরবরাহ সে তুলনায় কম। কারণ এসব উপকরণ এখনও ব্যাপকভাবে তৈরি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী এলাকা থেকে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করি। কাগজের তৈরি এসব আসবাব শুধু বাজারে বিক্রি হয় না, ওরশ ও মেলাগুলোতেও বিক্রি হয়। ঘর সাজাতে এসব উপকরণের জুড়ি নেই।’