প্রতি বছর কমপক্ষে তিন থেকে চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করতেন জয়পুরহাটের সদর উপজেলার ভেটি মণ্ডল পাড়ার কৃষক নূর ইসলাম। আলু তুলে রাখতেন কোল্ড স্টোরেজে। কিন্তু গত বছর আলুর দাম না থাকায় কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু উঠাননি। সব মিলিয়ে গত বছর ৫০ হাজার টাকা লোকসান গুনেছিলেন। গত মৌসুমের লোকসান কাটাতে এবারও আলুর চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি, এবারও গুনতে হচ্ছে লোকসানের হিসাব।
শুধু নূর ইসলামই নন, গত বছরের লোকসান কাটিয়ে তোলা এবং ভালো দাম পাওয়ার আশায় এবারও আলু রোপণ করেছেন জয়পুরহাটসহ নীলফামারী জেলার অনেক কৃষক। গত মৌসুমের চেয়ে এবার উৎপাদনও হয়েছে বেশ। কিন্তু আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় হতাশ এই দুই জেলার কৃষকেরা।
জয়পুরহাটের সদর উপজেলার বটতলি, সেগুনগ্রাম, ক্ষেতলাল উপজেলার মহনপুর, ভিরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় মিউজিকা, গ্রানোলা, ফ্রেশ, ক্যারেজ, রোমানা পাকরি এবং বট পাকরি আলুর আবাদ হয়েছে। এসব আলু তুলতে মাঠে মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
তারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বাড়লেও পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত মূল্য। ফলে লাভের হিসাব দূরে থাক, আলু বিক্রি শেষে লোকসানের হিসাবে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের কপালে।
এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, এখনও আলু তোলা ও বেশি দামে বিক্রির অনেক সময় রয়েছে। সে কারণে চাষিদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
জেলার নতুনহাট বাজারে আলু বিক্রি করতে আসা কৃষকেরা জানান, বাজারে প্রতি মণ ক্যারেজ আলু ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, গ্রানোলা আলু ১৬০ থেকে ২০০ টাকা, রোমানা পাকরি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা এবং বট পাকরি ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আলুর বাম্পার ফলন হলেও সপ্তাহের ব্যবধানে দাম প্রতি মণে কমে গেছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। দিন দিন দাম কমে যাওয়ায় যারা আলু তুলছেন, তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
নিউজবাংলাকে ক্ষেতলাল উপজেলার দুদু মিয়া বলেন, ‘বর্তমানে আলুর বাজার কম। আমার কিছুটা আগাম জাতের আলু ছিল। সেগুলো ৪৮০ টাকা মণ হিসেবে বাজারে বিক্রি করেছিলাম। এ জন্য খরচ বাদে কিছু টাকা লাভ করতে পেরেছি। এই আলু আজকের বাজারে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা মণ। আমার আরও কিছু জমিতে আলু আছে। সেগুলো সপ্তাহখানেক পরে তুলতে হবে। কিন্তু বাজার যেভাবে দিন দিন নেমে যাচ্ছে তাতে লোকসান গুনতে হবে।’
বাজারে আলুর দাম নিয়ে অনিশ্চয়তায় পাইকারি ক্রেতারাও। পাইকারি ক্রেতা বাবু বলেন, ‘বাজারে এখন আলু বেশি। কৃষকেরা প্রায় সবাই আলু তুলছেন। এসব আলু ঢাকা, সিলেট, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মোকামে সরবরাহ করা হচ্ছে। কাঁচাবাজারের মূল্য সঠিকভাবে বলা যায় না। এক সপ্তাহ পরে আলুর দাম বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে।’
নিউজবাংলাকে জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় এবার ৪০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আলু রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর ফলন ভালো হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রার বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে।
বর্তমানে আলুর বাজার কিছুটা নিম্নমুখী জানিয়ে বলেন, ‘এতে চাষিদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ ভালো দামে বিক্রি করতে পারবে- প্রত্যাশা তার।
ভরা মৌসুমে আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নীলফামারীর কৃষকরাও।
কৃষকরা বলছেন, বিঘাপ্রতি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ১৫-১৬ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারদর ৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলে বিঘাপ্রতি আসে ১২ হাজার টাকার কিছু বেশি।
নিউজবাংলাকে নীলফামারী সদর উপজেলার চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের আলুচাষি রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে আলু করেছি আমি। এখন বাজারদর অনেক খারাপ। মাঠে ৫ টাকা থেকে সাড়ে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে বিক্রি করলে লাভ তো দূরের কথা, খরচও উঠবে না।’
পলাশবাড়ি ইউনিয়নের বালাপাড়া এলাকার কৃষক জগদীশ রায় বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে আলু করেছি আমি। ১৫ হাজার টাকার কাছাকাছি খরচ হয়েছে। এবার দাম কম। ফলন ভালো হলেও বাজারদর ভাবিয়ে তুলছে আমাকে।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের দুরাকুটি গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এবার তিন বিঘা জমিতে আলু করেছি। যেখানে বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। আলু বিঘাপ্রতি ৭০ কেজির ৩৫ বস্তা হয়েছে।’
‘৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করলে আসে ১২ হাজার টাকার কিছু বেশি। সে হিসাবে জমিতে যে খরচ হয়েছে, সেটি আসছে না। লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে এবারও।’
নিতাই ইউনিয়নের পানিয়াল পুকুরের কৃষক আব্দুল জলিল আবাদ করেছেন দুই বিঘা জমিতে। তিনিও আলুর বর্তমান দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে আলুর কম দামে কৃষকরা হতাশ হলেও দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানান জেলা শহরের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আলুর এখন ভরা মৌসুম, সে কারণে দাম কম। আমরা ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকায় কিনছি, আর বিক্রি করছি ৬ টাকা দরে। তবে মাসখানেক পরে আলুর দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এ জেলায় সাগিতা, সেভেন, কারেজ, রোমানা, ডায়মন্ড, গ্রানোলা, অ্যাস্টোরিজ, বিরি আলু ৩৭, ৫৭ সহ বিভিন্ন জাতের আলু আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সেভেন, গ্রানোলা, সাগিতা, কারেজ জাতের আলু বেশি। জেলায় এবার ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৯১ মেট্রিক টন ধরা হয়েছে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘গত বছর এই সময়েও ভালো বাজার ছিল। কিন্তু এবার অনেক কম। কৃষকরা তাৎক্ষণিক মূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু সংরক্ষণের বিষয়টি ভাবেন না। সংরক্ষণ করলে লাভবান হওয়া যায়।’
এর সমাধানও দিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘এই এলাকায় আরও হিমাগার স্থাপন প্রয়োজন। তাহলে কৃষকরা হাতের নাগালে আলু সংরক্ষণে উদ্যোগী হবেন।’
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল আলম ডাবলু বলেন, ‘এই জেলায় যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়, তা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু কৃষকরা আলুর দাম পান না।
‘আমি মনে করি, সরকারিভাবে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং আলু দিয়ে তৈরীকৃত খাদ্যদ্রব্য কারখানা স্থাপন জরুরি। তাহলে আলুর ব্যবহার বাড়বে এবং আলুর খাদ্যদ্রব্যও পাওয়া যাবে এই এলাকায়। সে ক্ষেত্রে আলুর বাজারদরে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
কৃষকদের লোকসান কমাতে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আফজাল হোসেনও।
বলেন, ‘আপাতত বাজারদর কম, কিন্তু এই অবস্থা থাকবে না। যেভাবে হোক আলুগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
‘কারণ মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে। সে কারণে ওই এলাকায় আলুর ভালো ফলন হয়নি। এসব বিবেচনা করে আলু সংরক্ষণ করে রাখলে মাস দুয়েক বা তিনেক পর ভালো দাম আসবে।’
বীজ হিমাগার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘জেলায় ১১টি হিমাগার রয়েছে। আলু রাখার জন্য এগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারে একটি বীজ হিমাগার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সেটি হয়ে গেলে অনেক উপকৃত হবেন কৃষকরা।’