করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লোকসান কাটিয়ে গত বছরের শেষের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ‘মাদার শিল্প’ নামে খ্যাত বগুড়ার ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় আবারও হুমকিতে শিল্পটি।
মালিকরা বলছেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমাতে বাধ্য হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকলে লোকসান আরও বেশি হবে। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে কারখানা চালু রেখেছেন।
আমদানিকারকদের ভাষ্য, আন্তর্জাতিকভাবে দাম বৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি। এতে করোনা মহামারিরও প্রভাব রয়েছে।
কারখানা মালিকরা জানান, গত বছর প্রতি টন জাহাজ স্ক্রাব (ভাঙ্গারি) ২৮ হাজার থেকে ৩৩ হাজার টাকায় পাওয়া গেছে। সিলিকনের মূল্য ছিল এক লাখ টাকা। আর কয়লা (বোল্ডার) ৫০ হাজারেই পাওয়া গেছে।
তবে বছরের শেষ দিকে এই কাঁচামালগুলোর দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে জাহাজ স্ক্রাব কিনতে হচ্ছে প্রতি টন ৫২ হাজার টাকায়, সিলিকন প্রতি টন ৩ লাখ এবং কয়লা ৭০ হাজার টাকায়।
বগুড়ার বিসিক এলাকায় একটি টিউবওয়েল তৈরির কারখানা। ছবি: নিউজবাংলা
সংকট এখানেই শেষ নয়, বাজারে নতুন করে কোনো ব্যবসায়ী পণ্য নিতে চাইছেন না। কারণ অতিরিক্ত দামে তারা পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না। এ ছাড়া আগের উৎপাদিত অনেক পণ্য এখনও অবিক্রীত রয়েছে।
আবার খরচ বাঁচাতে মালিকপক্ষ উৎপাদন কর্মকাণ্ড চালু রাখছেন। তাদের হিসাবে কারখানার কাজ বন্ধ রাখলে গড়ে প্রতিটি ছোট ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। একইভাবে মাঝারি আকারের কারখানাগুলোর লোকসান দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ টাকা। বড় কারখানাগুলোর লোকসান আরও বেশি হবে।
গুঞ্জন মেটাল ওয়ার্কশপের জিএম জাকির হোসেন জানান, করোনার পর থেকে কারখানায় ৪ দিন করে ঢালাই কাজ হতো, কিন্তু এখন দুই দিন করে ঢালাই হচ্ছে।
জাকির বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমরা নই, সব মালিকই ঢালাই কমিয়ে দিয়েছেন।’
তিনি আরও জানান, অধিকাংশ ব্যবসায়ী এখন নতুন করে পণ্য কিনতে চাইছেন না। এই প্রবণতা ফাউন্ড্রি শিল্পে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
একই রকম অনিশ্চয়তার কথা বলেছেন ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজার রহমান মিলটন। তিনি বলেন, ‘কাঁচামালের দামের কারণে কয়েক মাস হলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি। তাই আমরা লোকসানে আছি।’
এদিকে কাঁচামালের অনুপাতে ফাউন্ড্রি শিল্পের উৎপাদিত পণ্যগুলোর দাম বাড়াতে পারছেন না কারখানার মালিকরা। কারণ বেশি দামে পণ্য ক্রয় করার মতো ক্রেতা এখন নেই। পাইকাররাও নতুন করে পণ্য নিতে রাজি হচ্ছেন না।
কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় আমদানিকারকদের সঙ্গেও। ঢাকার নবাবপুরের সাব্বির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. সাবের হোসেন জানান, গত দুই মাসের মধ্যে সিলিকনের দাম খুব ওঠানামা করেছে। চীন থেকে আমদানি করা সিলিকন গত বছর প্রতি টন ১ লাখ ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো। বর্তমানে এটি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া দেশের মধ্যে একমাত্র সিলিকন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রহিম স্টিল সম্প্রতি প্রতি টন সিলিকন ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিল। বর্তমানে দাম কিছুটা কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে তারা।
হঠাৎ করে দাম এত বাড়ার বিষয়ে সাবের হোসেন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সিলিকন, কার্বনসহ ক্ষতিকর দ্রব্য উৎপাদনে বা বিক্রিতে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে অন্যান্য দেশ। ফলে এসবের দাম বেড়ে গেছে। তবে সিলিকন উৎপাদনের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আনে শুধু সাউথ আফ্রিকা থেকে। সেখানে কোনো দাম বাড়েনি। তারপরও তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল।’
এ ছাড়া মহামারির মধ্যে পণ্য পরিবহনে জাহাজভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ কারণেও সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে বলে জানান সাবের।
জাহাজের ভাঙ্গারির দাম নিয়ে চট্টগ্রামের আর ওয়াই করপোরেশনের মালিক হাজি মো. ইসহাক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজের দাম এখন অনেক বেড়েছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে জাহাজ ভাঙ্গারি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, গত বছরের জুন মাসের পর থেকে এই দাম বাড়তে শুরু করে।
মালিকরা জানিয়েছেন, লোহা গলানোর জন্য কয়লার ফার্নেসে উৎপাদন ব্যয় বেশি। এর বদলে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক ইনডাকশন মেশিন থাকলে খরচ কম হতো।
কয়লার বিষয়ে আরেক আমদানিকারক চট্টগ্রামের এমএস করপোরেশনের মালিক আশরাফ হোসেন জানান, লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে জাহাজে করে কয়লা আসা এখন বন্ধ। এ কারণে কয়লার চাহিদা বেড়েছে।
ফাউন্ড্রি শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজিজার রহমান মিলটন বলেন, ‘জেলায় বছরে হাজার কোটি টাকা আয় এনে দেয় এই ব্যবসা।
কিন্তু এখনও এটি চলে পুরোনো পদ্ধতিতে। এ জন্য আমাদের উৎপাদনের ব্যয়ও বেশি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফাউন্ড্রি শিল্পকে আধুনিকায়ন করতে হবে। তবে সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এই আধুনিকায়ন অসম্ভব।’
জেলা বিসিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিল্পনগরী হিসেবে বগুড়াকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে ফাউন্ড্রি শিল্প। মূলত পুরোনো লোহা আগুনে গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে নির্দিষ্ট আকারের যন্ত্র কিংবা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় বলেই এ ধরনের শিল্পকে ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প বলা হয়।
বগুড়ার বিসিক এলাকায় প্রায় ৪৬টি ঢালাই কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া বিসিকের বাইরে জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় মিলিয়ে আরও অন্তত ৩০০টি কারখানা গড়ে উঠেছে।
এসব কারখানায় কর্মরত আছেন অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক। আর এই শিল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে নিয়োজিত জেলার আরও ২৫ হাজার মানুষ।
এসব কারখানায় অর্ধশত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পানির পাম্প ও এর লায়নার, পিস্টনসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশ, হ্যান্ড টিউবওয়েল (নলকূপ), সব ধরনের হুইল, পাওয়ার টিলারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিনের যন্ত্রাংশ, করাত কল, চিঁড়া তৈরির কল, অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ, ফ্লাওয়ার মিলের যন্ত্রাংশ, টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রাংশ, মোটরগাড়ির স্প্রিং, ব্রেক ড্রাম, গ্র্যান্ডিং মেশিন, অয়েল মিল ও জুট মিলের যন্ত্রপাতি।
এর মধ্যে পানির পাম্প ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান, মিয়ানমারে নিয়মিত রপ্তানি করা হয়।
বগুড়ার ঢালাই কারখানাগুলোতে কৃষি ও সেচ যন্ত্রাংশই সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়। এসব পণ্যে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগ এখান থেকেই যোগান দেয়া হয়।
বিসিকের তথ্য মতে, তাদের আওতাধীন এলাকায় গড়ে ওঠা ৪৬টি কারখানা থেকে বছরে গড়ে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করা হয়। আর বাইরের কারখানাগুলো মিলে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২১ সালের রপ্তানির পরিসংখ্যানে তিনটি ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ- এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৯৪ লাখ টাকার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প ভারতে রপ্তানি করেছে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, ‘ফাউন্ড্রি শিল্প বগুড়ার গর্ব। এই শিল্পকে বিকশিত তথা আধুনিকায়ন করতে পারলে দেশসহ বিশ্ববাজারে বগুড়া জেলা অনেকদূর এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি জেলার আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।’
জেলা বিসিকের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বাড়ার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে এর দাম বাড়ার প্রবণতা শিল্পটির জন্য ক্ষতিকর।’