গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে একের পর এক জেব্রার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত চলাকালে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারি কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রকল্প পরিচালককে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াও।
জেব্রার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রত্যাহার হওয়া কর্মকর্তারা হলেন সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান এবং ভেটেরিনারি কর্মকর্তা হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকারনাইন। তাদেরকে ঢাকার বন অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তাদের পরিবর্তে পার্কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ফরিদপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম এবং কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে।
এ ছাড়া সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবিরকেও প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে রোববার পার্ক পরিদর্শন শেষে গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অভিযোগ তুলেছিলেন, পার্কে ওই ১১টি জেব্রাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘১১ জেব্রার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। জেব্রাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একে অপরকে ফাঁসানোর জন্য এই জেব্রাগুলো হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমি মামলা করব।
‘গত মাসে সাফারি পার্কে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এটা কেউ জানে না। এত মূল্যবান প্রাণী মারা যাচ্ছে, অথচ পার্ক কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে যাচ্ছে। পার্কে ১০টি বাঘ ছিল, একটি পুরুষ বাঘ মারা যাওয়ায় এখন মোট বাঘের সংখ্যা ৯টি।’
জেব্রাগুলোকে হত্যার অভিযোগ তদন্তে সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের বদলি করা জরুরি বলেও মত দিয়েছিলেন এমপি।
তিনি তদন্ত কমিটির সদস্যদের বলেছিলেন, ‘যাদের তত্ত্বাবধানে জেব্রা মারা গেছে তাদের স্বপদে বহাল রেখে সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়। এতে পার্কের অন্য কর্মচারীরা মুখ খুলতে সাহস পাবে না। পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমানকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তারপর তদন্ত করতে হবে।’
পার্কে গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ১১ জেব্রার মৃত্যু হয়।
পার্ক কর্তৃপক্ষ যা জানায়
পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির এর আগে জানান, ১১টির মধ্যে সবশেষ শনিবার সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে মারা যায় দুটি।
তিনি জানান, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চারটি জেব্রা মারা গেছে। আর বাকিগুলোর মৃত্যু হয়েছে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে।
৯টি জেব্রারই মৃত্যু হয়েছে গত ২ থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে। নেতিবাচক পরিস্থিতির কথা ভেবেই তাৎক্ষণিকভাবে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তবে মৃত্যুর পর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সবগুলো জেব্রার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
পরে তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা ঢাকার মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার ও ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়।
গত সোমবার রাতে সেসবের রিপোর্ট এসেছে। পরদিন সকাল থেকে জেব্রাগুলোর মৃত্যুজনিত কারণে বিশেষজ্ঞ দল পার্ক পরিদর্শন করেন। দুপুরে তারা পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
এ সময় মৃত জেব্রাগুলোর সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা. এ বি এম শহীদ উল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নুর আলী খান, ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম, ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম উকিল উদ্দিন ও সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. হাতেম সাজ্জাত জুলকারনাইন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের অধ্যাপক রফিকুল আলম বলেছিলেন, ‘এসব প্রাণীর মৃতদেহে পাঁচ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’
বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রফেসর আবু হাদী নুর আলম খান ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে বলেছিলেন, ‘একই ঘাস সব ধরনের তৃণভোজী প্রাণী খাচ্ছে। অন্য কোনো প্রাণীর সমস্যা হচ্ছে না, শুধু জেব্রারই হচ্ছে। এ জন্য আপাতত অবজারভেশনের জন্য এক সপ্তাহ বা দশ দিন ঘাস পরিবর্তন করে অন্য জায়গার ঘাস দেয়া হবে। সব প্রাণীর পাকস্থলীর ক্ষমতা বা হজমক্রিয়া এক রকম না।’
তিনি জানান, অন্যান্য প্রাণীকে যথারীতি আগের খাবারই দেয়া হবে। তবে সতর্কতা হিসেবে সেই খাবারগুলো প্রথমে ধুয়ে তারপর চপিং মেশিনে দিয়ে ছোট ছোট করে কেটে শুকিয়ে তারপর সরবরাহ করা হবে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ বলেছিলেন, ‘মানিকগঞ্জ থেকে ঘাস এনে জেব্রার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। সেখানকার ঘাস পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাই বর্তমানে অবশিষ্ট যে প্রাণীগুলো সাফারি পার্কে আছে তাদের সুস্থতায় বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি বাকি প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারব।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাকি প্রাণীগুলোকেও নজরদারি করা হচ্ছে। তাদেরকে খাবারের সঙ্গে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন মলসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।’
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘হঠাৎ করে এভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যু খুবই কষ্টকর। নিজের হাতে লালন পালনের পর চোখের সামনেই এদের মৃত্যু দেখতে হলো। অসুস্থ হওয়ার মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যেই মারা গেছে জেব্রাগুলো। এখানে আমাদের কারও কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল না।