ফাঁসিতে ঝুলতে হবে, এমন রায় শুনে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশকে দেখা গেছে ভাবলেশহীন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আরেক আসামি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে দেখা গেছে বিমর্ষ।
সোমবার বিকেলে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে দুই প্রধান আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছাড়াও ছয়জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় সাতজনকে দেয়া হয়েছে খালাস।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এদিন সকাল থেকেই আদলত চত্বরে পুলিশের ব্যাপক নজরদারি দেখা গেছে। মোতায়েন করা হয়েছিল অন্তত ২০০ পুলিশ। ছিল র্যাবসহ অন্য সংস্থার সদস্যরাও। এর মধ্যেই আদালতে আসামিদের হাজির করার সময় পেছানো হয়।
সিনহা হত্যা মামলার কার্যক্রম অন্যদিন সকাল সাড়ে ৯টার পর শুরু হলেও এদিন তা দুপুরে গড়ায়। মামলার ১৫ আসামিকে বেলা ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালত চত্বরে আনা হয়। ওই সময় ওসি প্রদীপের ফাঁসির দাবিতে টেকনাফের সাধারণ জনতা ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে আদালত চত্বরে মানববন্ধন হয়।
আসামিদের আদালতে তোলার পর ৩০০ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। এ সময় বরখাস্ত ওসি প্রদীপকে বিমর্ষ দেখা গেছে। মৃত্যুদণ্ড সাজা পাওয়ার পরও তিনি ভাবলেশহীন ছিলেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। রায় শুনে প্রদীপ কিছু বলেননি। চুপচাপ ছিলেন লিয়াকতও।
কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট নয়
এই মামলার রায়ে রাষ্ট্র, আসামি বা বাদীপক্ষ-কেউই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। রায়ের পর তিন পক্ষই গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন।
রায়ে আংশিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। আর আসামিদের খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম বলেন, ‘এ রায়ে আমরা আংশিক সন্তুষ্ট। কারণ যে সাতজনকে খালাস দেয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামিদের মতো অপরাধী। তাই এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করব।’
সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল মামলার প্রধান দুই আসামির যেন সর্বোচ্চ সাজা হয়। সেটা পূরণ হয়েছে। তবে সাতজনকে যে খালাস দেয়া হলো, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, তাদেরও কিছুটা দায়বদ্ধতা ছিল। একেবারেই যে দায়বদ্ধতা ছিল না তা না। সে ক্ষেত্রে হয়তো তাদের কিছু সাজা হতে পারত বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়।
‘আর সন্তুষ্টির কথা যদি বলেন, সন্তুষ্টি সেদিনই হবে যেদিন রায়টি কার্যকর হবে।’
রায়ে আংশিক অসন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী সালাউদ্দিন বলেন, ‘এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। নুরুল আমিন আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনের কী অপরাধ? তারা তো পুলিশের করা মামলার সাক্ষী ছিল। কিন্তু তাদের এ মামলায় এনে যাবজ্জীবন দেয়া হলো। আমি তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে উচ্চ আদালতে যাব।’
যাদের যাবজ্জীবন
রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, নুরুল আমিন, নিয়াজ উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিনকে।
যারা খালাস
খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন পিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহ এবং থানা পুলিশের কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও লিটন মিয়াকে।
এদেরকে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দেয়া হলেও অন্য আসামিদের সঙ্গেই নেয়া হয় কক্সবাজার কারাগারে। পুলিশ জানায়, আদালতের নথি পৌঁছার পর তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে।
সিনহা হত্যা
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র বানানোর জন্য প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার একটি রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে তল্লাশিতে বাধা দেন। পরে পিস্তল বের করলে চেকপোস্টের পুলিশ তাকে গুলি করেন।
ওই বছরের ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
সিনহা নিহতের ছয় দিন পর লিয়াকত আলী, প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে এই হত্যায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানিয়ে টেকনাফ থানায় করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
প্রায় সাড়ে চার মাস তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর কক্সবাজারের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।