বাংলাদেশে নারীরা যেসব ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ রোগী স্তন ক্যানসারের।
দুরারোগ্য এ ব্যাধিতে আক্রান্ত নারীদের ২৮ শতাংশই স্তন ক্যানসারের বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ গবেষণাটি করেছে। গবেষণা করতে বিএসএমএমইউতে সেবা নেয়া ক্যানসার রোগীদের প্যাথলজিভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি কার্যক্রম থেকে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গত বছরের ১ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএমএমইউর সার্জারি বিভাগে হিস্টোপ্যাথলজিকাল ডায়াগনসিসের জন্য যারা সজিন্স টিউমারের নমুনা জমা করেছেন, তাদের কাছ থেকে ক্যানরেজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়। এক মাসে ১ হাজার ৬৫৬ ক্যানসার রোগীর নমুনার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ ফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষকদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সঠিক সময়ে ক্যানসার শনাক্ত না হওয়ায় চিকিৎসাধীন ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
গবেষণার তথ্য বলছে, ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ২৮ দশমিক ০১ শতাংশ রোগী স্তন ক্যানসারের। এ ছাড়া থাইরয়েডজনিত ক্যানসারে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ, জরায়ুমুখ ক্যানসারে ১২ দশমিক ২ শতাংশ এবং লিউকেমিয়া ক্যানসারে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আক্রান্ত হয়েছেন। বাকিরা অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার বা আইএআরসির ২০১৯ সালের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬ হাজার নারীর মৃত্যু হচ্ছে। বর্তমানে এই রোগী সংখ্যা ২ হাজারের উপরে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ১৯ শতাংশ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত, তবে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা বলছে, এই হার ২৮ শতাংশ।
গবেষকদের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রতিনিয়ত স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার বাড়ছে, তবে কেন এ হার বাড়ছে, এ বিষয়ে আরও গবেষণা করা দরকার।
বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেহরিন এমদাদ রায়না বলেন, ‘কেন অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় নারীদের বেশি স্তন ক্যানসার দেখা দিচ্ছে, এটার জন্য নতুন করে গবেষণা করতে হবে।’
তিনি বলেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়। সেটি রক্তনালির লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যানসার। কয়েক বছরে এ ক্যানসারে আক্রান্তের হার অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে মানুষের চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এখন গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে মানুষ ঢাকায় আসেন।
শেহরিন আরও বলেন, রক্ষণশীলতার কারণে বাংলাদেশে নারীরা স্তনে পরিবর্তনের কথা অনেক সময় গোপন রাখেন। নারীরা যেখানে প্রকাশ্যে স্তন শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না, সেখানে শরীরে প্রাথমিক কোনো লক্ষণ দেখা গেলেও তারা গোপন রাখেন। এ কারণে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন একেবারে শেষ পর্যায়ে।
পুরুষরাও হন আক্রান্ত
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্তন ক্যানসারে শুধু নারীরা নন, পুরুষেরাও আক্রান্ত হতে পারেন। এ নিয়ে রয়েছে সচেতনতার অভাব। দেখা যায় যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের বেশিরভাগই আসেন প্রায় শেষ পর্যায়ে। অধিকাংশ সময় তারা স্তনে একটি চাকা নিয়ে আসেন।
অনেকে স্তনের বোঁটায় ঘা বা ক্ষত বা বোঁটার চারপাশে কালো অংশে চুলকানির লক্ষণ নিয়ে আসেন। কারও স্তনের বোঁটা দিয়ে দুধের মতো সাদা রস নিঃসৃত হতে থাকে। ব্যথা বা স্তন লাল রং হয়ে গেছে, এমন লক্ষণ নিয়েও আসেন।
যেসব কারণে স্তন ক্যানসার
জীবনাচরণ এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে এই ক্যানসার দেখা দিতে পারে বলে জানান বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেহরিন এমদাদ রায়না।
তিনি বলেন, কারও পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে অন্যজন আক্রান্ত হতে পারে। কারও ১২ বছরের আগে ঋতুস্রাব এবং দেরিতে ঋতু বন্ধ হলে, তার ঝুঁকি থাকে। সেই সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিএসএমএমইউর এ অধ্যাপক বলেন, দেরিতে সন্তান গ্রহণ, বন্ধ্যত্ব, সন্তানকে বুকের দুধ পান না করানো, খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি বা ফলমূলের চাইতে চর্বি ও প্রাণিজ আমিষ বেশি থাকা, প্রসেসড ফুড বেশি খাওয়া এবং স্থুলতা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে বা হরমোনের ইনজেকশন নিলেও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি হয়।