ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুর রেলস্টেশনের কাছাকাছি কুমার নদে এখনও আছে সোজন বাদিয়ার ঘাট। স্টেশনের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোলেই নদীটির পাড়ে আছে একটি শ্মশানঘাট। তার কিছু দূরেই কবির বাসভবন।
কবির বাড়ির সামনে দিয়েই কুমার নদ চলে গেছে শহরের মাঝখান দিয়ে। নদের পাশেই বিশাল মাঠ। সেখানেই মেলা হতো প্রতি বছর।
বাড়ির প্রবেশপথের শুরুতেই পারিবারিক কবরস্থান। যেখানে ডালিমগাছের তলে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন।
তার পরিবারের সবার কবরও সেখানে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথ। ঢুকতেই বড় বড় দুটি আমগাছ। আমগাছ পেরোলেই কবির পিতা-মাতার বাসভবন। বাসভবনের ভেতরে রয়েছে তাদের উঠোন।
উঠোনের পূর্ব পাশের ঘরটিতেই থাকতেন পল্লীকবি। সেখানে বসেই তার সব রং-রূপ চেতনা মিশিয়ে আবহমান বাংলার রূপ তুলে ধরতেন গল্প, কবিতা, গীতকাহিনি আর উপন্যাসে।
তার ঘরের পাশে ছিল রান্নাঘর। সেখানে আজও আছে একটি ঢেঁকি। বাড়ির ভেতরে আরও কয়েকটি ঘর। কোনোটি তার ভাইয়ের, কোনোটি ছেলের।
বাড়ির ভেতরে বড় দুটি আমগাছ। আছে একটি সফেদাগাছও। এ ছাড়া অন্যান্য গাছের মধ্যে কোনোটি কবির লাগানো, কোনোটি তার মায়ের লাগানো, কোনোটি তার স্ত্রীর।
পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আজও সংরক্ষিত। কেউ ছুঁতে না পারলেও এগুলোতে এখন ধুলোর আস্তরণ। কিছু তার নষ্ট হতে চলেছে। তাই কবির স্মৃতিতে বিমুগ্ধ দর্শনার্থীর অনেকেই কিছুটা বিষাদ নিয়েও ফিরে আসেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়িটি ঘিরে প্রতি বছর আয়োজন করা হতো ‘জসীম পল্লী মেলা’। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে বন্ধ সেই মেলাও। ফলে জসীমভক্ত ও স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ বছর ১ মার্চে মেলার দিন ঘোষণা করা হলেও করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবে তা এখন অনিশ্চিত। মহামারি শেষ হলে আবারও জসীম মেলা শুরু হবে- এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় মানুষের।
স্থানীয়দের ভাষ্য, শীত মৌসুমে বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থী ও কবিপ্রেমীরা পল্লীকবির বাড়িটি দেখতে আসেন, কেউ পিকনিক করেন। কিন্তু তারা হতাশ হন। বাড়িটিতে নেই কোনো বসার স্থান। পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থাও নাজুক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জসীম উদ্দীনের বাড়ির কাছেই নির্মিত হয়েছে জসীম সংগ্রহশালা। কিন্তু এর কোনো প্রচার না থাকায় অনেকটাই লোকশূন্য। অযত্ন আর অবহেলা কাটিয়ে কবির বাড়িটিকে ঘিরে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে- এমনটাই প্রত্যাশা কবির ভক্ত অনুরাগীদের।
এ বিষয়ে স্থানীয় বক্তার খান বলেন, ‘আমি জসীম ফাউন্ডেশনের শুরুর দিকের সদস্য। কিন্তু এখন আছি কি না জানি না। এখানে কোনো কিছুই নিয়ম-কানুন মেনে হয় না। কোনো উন্নয়ন নেই। বাড়ির পেছনের দিকে মিউজিয়ামটা করার কারণে কারো দৃষ্টিতে আসে না। প্রচার নেই।’
কবির প্রতিবেশী জাহিদ হোসেন জানান, সরকারের দিক থেকে কবির বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় একজন ঝাড়ুদার নিয়োজিত আছেন।
কবির বাড়িতে দায়িত্ব পালনরত ও আত্মীয় ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘আমরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না বললেই চলে। নিজেদের উদ্যোগেই টিকিয়ে রেখেছি এই বাড়ি।’
এ ছাড়া কবির বাড়ির পাশে অম্বিকাপুর রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু এখানে থামে না কোনো ট্রেন। এলাকাবাসীর পক্ষে এখানে ট্রেন থামার পাশাপাশি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে জসীম মেলা চালুর দাবি জানান স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সামছুল আরেফিন সাগর।
এদিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ‘পল্লীকবির বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে, বিষয়টি পুরোপুরি এমন নয়। কবির বাড়িটিকে সরকারের আওতায় নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
এ ছাড়া মহামারি না বাড়লে জসীম পল্লী মেলার আয়োজনসহ এলাকাবাসীর বিভিন্ন দাবির বিষয়টি গুরুত্ব নিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।