প্রবাদ বাক্যই সত্য হলো। মাঘ মাসের প্রথমার্ধেই বাঘ পালানো শীত পড়েছে দেশজুড়ে। তবে এমন শীতে প্রকৃত বাঘদের খবর জানা না গেলেও জেলায় জেলায় মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত মানুষই এর প্রধান ভুক্তভোগী।
দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলীয় তিন জেলার সরেজমিন প্রতিবেদনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট।
এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় নীলফামারী জেলায় কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় জনজীবন এতটাই বিপর্যস্ত যে, সড়কে মানুষের চলাচল কমে গেছে। ঘন কুয়াশায় দিনের বেলায়ও যানবাহন চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।
তারপরও থেমে নেই এ জেলার জনজীবন। জীবিকার তাগিদে বের হতেই হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষদের।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে নীলফামারী জেলায়। এতে গত কয়েক দিন ধরেই নীলফামারীসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবস্থান করছে।
ফলে শীতের পোশাক ছাড়াও অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তবে তিস্তাবেষ্টিত এলাকার মানুষজন পড়েছেন সবচেয়ে বিপাকে। শীত নিবারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের শামসুল ইসলাম বলেন, ‘খুব ঠান্ডা। দিন কাটায় যায়ছে না। হাড্ডিত নাগেছে ঠান্ডা। সাথে বাতাস কাহিল করি ফেলাইছে হামাক। বেলা গড়ি গেইলেও সূর্যের দেখা যায়ছে না।’
সৈয়দপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ লোকমান হোসেন জানান, ওই অঞ্চলে এমন অবস্থা আরও কয়েক দিন থাকবে। তবে তাপমাত্রা ওঠানামা করবে এই সময়টিতে। মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহও বিরাজ করতে পারে।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল জানান, শীতের কারণে রোগীর সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে সাধারণ সর্দি-কাশি ছাড়াও ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেশি। এ ধরনের আবহাওয়ায় শিশুদের কুসুম গরম পানি, ধুলাবালি থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোর মধ্যে নীলফামারীতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেয়া ৩০ হাজার ১০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে। এ ছাড়া সংসদ সদস্য, উপজেলা, পৌরসভা ও জেলা প্রশাসকের নামে বরাদ্দ হওয়া ৭৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩৬৮ টাকার কম্বল সংগ্রহ করে বিতরণের প্রক্রিয়া চলছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে কম্বল বিতরণের পাশাপাশি শিশুদের শীত নিবারক পোশাকও বিতরণ করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহের ফুটপাতে ভিড়
গত কয়েক দিন ধরে ঘন কুয়াশার সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে ময়মনসিংহেও। এতে এ জেলার খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষজন পড়েছেন বিপদে।
ময়মনসিংহ ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে দুপুরে সূর্যের দেখা মিললেও রোদের উত্তাপ নেই বললেই চলে।
এ অবস্থায় শহরের ফুটপাতের দোকানগুলোতে শীতের কাপড় কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। শহরের গাঙ্গিনাড়পাড়, বাসাবাড়ি ও ট্রাংপট্টি এলাকার অস্থায়ী দোকানগুলোতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
রোববার বিকেল ৪টার দিকে ময়মনসিংহের ট্রাংপট্টি এলাকায় ফুটপাত থেকে শিশুকন্যার জন্য সোয়েটার কিনছিলেন আমেনা বেগম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্বামী ব্যস্ত থাকায় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে কম দামে জামা কিনতে এসেছি। কারণ হঠাৎ শীত বেড়ে গেছে।’
বাসাবাড়ি ফুটপাত থেকে জ্যাকেট কেনার সময় আব্দুর রহমান নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে বাড়ি থেকে ভোরে রওনা দেই। আগে বেশি শীত না লাগলেও, এখন সকাল ও সন্ধ্যার পর থেকেই খুব শীত নামছে।’
গত এক সপ্তাহ ধরেই শীতের কাপড় কিনতে আসা মানুষের ভিড় বেড়েছে বলে জানান বাসাবাড়ির ফুটপাতের দোকানি ইকরামুল হক।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফাল্গুনী নন্দী জানান, জেলা পুলিশ ও পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে প্রতি বছরই শীতার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। গত শনিবার রাতেও দুই শতাধিক শীতার্ত ও দরিদ্র মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া হয়েছে। শীতের প্রকোপ না কমা পর্যন্ত এমন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
বিপর্যস্ত চরাঞ্চল
ফরিদপুরকে বলা হয় দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর বাণিজ্যিক শহর। আশপাশের অঞ্চলসহ এই জেলায়ও এখন তীব্র শীত জেঁকে বসেছে।
এতে জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার চরাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে এখন কোল্ড ডাইরিয়ার ছড়াছড়ি।
ফরিদপুরের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলবাসী, নদী পারের বসতি, বিভিন্ন বেড়িবাঁধ ও উন্মুক্ত ফসলি মাঠের পাশে বসবাসকারীরাই শীতে সবচেয়ে বেশি কাবু হয়েছেন।
চরভদ্রাসনের গাজীরটেক ইউনিয়নের বিন্দু ডাঙ্গী গ্রামের লক্ষ্মী রানী জানান, তার স্বামী চিত্ত হালদার পদ্মা নদীর একজন মৎস্যজীবী। গত তিন দিন ধরে তীব্র শীতের কারণে অসুস্থ হয়ে তিনি নদীতে যেতে পারেননি। তাই সংসারে অভাব দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিনের তীব্র শীতে পদ্মাতীরের ভাঙনকবলিত ও ছিন্নমূল পরিবারগুলোই সবচেয়ে ভুক্তভোগী। এসব পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে শীতজনিত রোগ লেগেই আছে। দিনের অধিকাংশ সময় রোদ না থাকায় তারা আরও কাবু হয়ে পড়ছেন। কাবু হয়েছে গৃহপালিত পশুও।