চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে সরাসরি কন্টেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে । এই রুটের প্রথম জাহাজ হিসেবে সোঙ্গা চিতা পণ্য নিয়ে ইতালির রেভনা বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাবে।
রোববার বিকেলে এ তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম।
তিনি বলেন, ‘সোঙ্গা চিতা এখন চট্টগ্রামের উদ্দেশে সমুদ্রপথে রয়েছে। কবে নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে তা এখনও নিশ্চিত নই। এটি বন্দরে পৌঁছার ২-৩ দিন পরই পণ্য নিয়ে যাত্রা করবে। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাহাজটি পণ্য নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হতে পারে।’
বন্দরের এ কর্মকর্তা জানান, ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হলে শিপিংয়ের ব্যয় ও সময় দুই-ই কমবে। খরচ কমবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
বন্দরের পরিবহন বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপের যেকোনো দেশে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ৪০দিন। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্ট।
সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হলে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ১৬ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম থেকে ইতালি পৌঁছা যাবে। এতে সময় কমবে ২৪ দিন। ব্যয় কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, ইতালিয়ান শিপিং কোম্পানি ক্যালিপসো কোম্পাজনিয়া ডি নেভিগ্যাজোনে এসপিএ দুটি কন্টেইনার জাহাজ-সোঙ্গা চিতা ও কেপ ফ্লোরেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পরিবহন করবে। প্রাথমিকভাবে জাহাজ দুটি ২৫ দিন পর পর চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য পরিবহন করার কথা।
এর মধ্যে কেপ ফ্লোরেস জাহাজটি মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী। আর সোঙ্গা চিতা লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী। জাহাজ দুটির স্থানীয় এজেন্ট রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস।
রিলায়েন্স শিপিংয়ের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ জানান, জাহাজ সোঙ্গা চিতা ১১০০ টিইউএস রপ্তানি পণ্য নিয়ে যাত্রা করবে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ তৈরি পোশাক। বাকি ২ শতাংশ হ্যান্ডিক্রাফট ও চামড়া এবং পাটজাত পণ্য।
বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে ইতালিভিত্তিক কন্টেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের রটারড্যাম, অ্যান্টওয়ার্প ও হামবুর্গের মতো মূল বন্দরে (বেজ পোর্ট) যাওয়ার আগে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, তানজুম পালাপাস, কেলাস ও চীনের কিছু ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের ইতালি যেতে হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি ২০২১ সালে ১৫.২৫ লাখ টিইইউএস রপ্তানি কন্টেইনার হ্যান্ডল করেছে। এর মধ্যে শুধু ইউরোপে গেছে ৫৭ হাজার ২০০ টিইইউএস কন্টেইনার পণ্য।
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বৃহত্তম বাজার ইউরোপ। কনটেইনার জাহাজ চলাচলের সরাসরি রুটটি জনপ্রিয় হলে দেশের রপ্তানি খাতে নতুন মাইলফলক তৈরি হবে। এতে নতুন ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং দেশের রপ্তানি খাত প্রসারিত হবে। এটি দেশের রপ্তানি খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক ব্যাপার।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপে পাঠানোর সময় পণ্য লোড, আনলোড, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের স্টোর চার্জসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বহন করতে হয়। সরাসরি পরিবহন শুরু হলে বিশাল অংকের টাকা বেঁচে যাবে। পণ্য পরিবহন ব্যয় কমলে বিদেশি ক্রেতারা লাভবান হবেন। এটি নতুন ক্রেতা সৃষ্টিতেও বড় ভূমিকা রাখবে।
তবে বড় শিপিং লাইনগুলো ছোট জাহাজ দিয়ে ইতালিতে পণ্য পাঠাতে তেমন আগ্রহী নয়। বে-টার্মিনাল হয়ে গেলে ইউরোপে সরাসরি পণ্য পরিবহনে শিপিং লাইনগুলো এগিয়ে আসবে বলে মন্তব্য করেন মেডিটেরিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) সহকারী মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসাইন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ইতালির সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচলের বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখি। তবে কতটুকু সফল হবে তা দেখার বিষয়। এখানে একটি নির্দিষ্ট শিপিং লাইনের পণ্য পরিবহন হবে, যা পরিমাণে খুবই কম। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা কম হওয়ায় মাদার ভেসেল ভেড়ানো সম্ভব নয়। তাই ছোট জাহাজে করেই ইতালিতে পণ্য পরিবহন করতে হবে। তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি পণ্য পরিবহন দেশের রপ্তানি খাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই সেবা যেন ব্যাহত না হয় তা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে মেইন লাইনগুলো ঠিকভাবে কন্টেইনার সরবরাহ করছে না। ফ্রেইট চার্জ ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ১০ গুণ বেড়ে গেছে। জাহাজের মালিক-চার্টারার ও ব্যবস্থাপক এই বিষয়গুলো নিয়ে দুর্ভোগে আছেন। বাড়তি টাকা ব্যয় করেও সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।’
তিনি বলেন, ‘নিজেরাই জাহাজ চার্টার করবেন, নিজেরাই নিয়ে যাবেন- এমন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করেছে। আশা করছি, অন্য মেইন লাইন অপারেটরও এই রুটে জাহাজ চলাচলে উদ্যোগী হবেন। তখন ফ্রেইট চার্জ আরও কমে আসবে।’