জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে নির্জন এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে ছোট ছোট সাদা রঙের ঢিবি। দেখতে সুন্দর হলেও মাটি, ইট ও কাঠের গুঁড়া দিয়ে বানানো এসব ঢিবি মূলত বন উজাড়ের মাধ্যম।
স্থানীয়রা এটিকে চুলা বা চুল্লি বলেই চেনে। নির্বিচারে কেটে আনা মণকে মণ গাছ এসব চুল্লিতে পুড়িয়ে বানানো হয় কয়লা। আর নির্গত ধোঁয়ার কুণ্ডলী দূষণ ছড়াচ্ছে পরিবেশে। পাশাপাশি হুমকিতে পড়ছে জনজীবন ও জৈববৈচিত্র্য।
এসব চুল্লির মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহস পায় না কেউই। জনপ্রতিনিধিদেরও সুর নরম। তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে দ্রুত এসব চুল্লি ভেঙে ফেলার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে ঢাকার ধামরাই উপজেলার দুটি ইউনিয়নে এমন ২০টির মতো চুল্লির সন্ধান পাওয়া গেছে। বনের কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির এমন প্রক্রিয়া অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও এসব এলাকার বাসিন্দাদের কাছে পুরোনো।
বাইশাকান্দা ইউনিয়নের গোলাকান্দা গ্রামে আটটি চুল্লির মালিক হারুন অর রশিদ। আর বালিয়া ইউনিয়নের বাস্তা গ্রামে আরও ছয়টি চুল্লির মালিক নাহিদ রানা ও মো. ইমরান।
দক্ষিণ গাঁওতারা এলাকায় দুটি চুল্লির মালিক নুরুল ইসলাম। চুল্লিগুলোর সামনে কেটে রাখা হয়েছে কাঠের স্তূপ। প্রতিটি চুল্লিতে ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ দিয়ে আগুন দেয়ার পর খোলা অংশটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর টানা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কাঠ পোড়ানো শেষ হলে কয়লা বের করা হয়। একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কয়লা পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, যখন কাঠ পোড়ানো শুরু হয়, তখন চুল্লি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে থাকে। এতে আশপাশের পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে সময় রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে চোখ জ্বালাপোড়া করে, শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়।
ধামরাই পরিবেশ আন্দোলনের আহ্বায়ক সিয়াম সারোয়ার জামিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব কয়লা কারখানা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। একে তো নির্বিচারে গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করে এখানে পোড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে ধোঁয়া পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
বালিয়া ইউনিয়নের গ্রামের চুল্লির মালিক নাহিদ রানার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমারডা অবৈধ। সব অবৈধ ব্যবসা এগনা। যেমনে চালাইতে পারি চালাই। না পারলে বন্ধ থাকব।’
নাহিদের সঙ্গী আরেক মালিক মো. ইমরান বলেন, ‘ওহানে যা আছে আমাগো দুইজনেরই। পাঁচটা চুলা আছে। কতগুলা কয়লা হয় হিসাব নাই। একেক সময় একেক রকম বাইর হয়। কাঠ এইগলা বিভিন্ন জায়গা থাইকা ব্যাপারী আইসা দিয়া যায়।’
আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘ওইসব ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওইগলা সব আমার পার্টনার নাহিদ জানে।’
দক্ষিণ গাঁওতারা এলাকার নুরুল ইসলাম নামে আরেকজন চুল্লির মালিক বলেন, ‘লিখিত কোনো অনুমতি নেই। অনুমতি সবারই মুখে মুখে আছে। পরিবেশের ক্ষতি তো একটু হইবই।’
বাইশাকান্দা ইউনিয়নের গোলাকান্দা গ্রামে হারুন অর রশিদের চুল্লির তথ্য সংগ্রহের সময় তার লোকজন বিদ্রূপ করে বলেন, ‘ছবি তুইলা নিয়া যান গা। আপনারা নিউজ করলে কী হইব?’
তবে চুল্লির মালিক হারুন অর রশিদকে অনেকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটার বিরুদ্ধে ওই গ্রামের লোকজনকে আইডিয়া দিছি। তারা এসবের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরও নিয়েছে। ওরা যারা (চুল্লির মালিক) কাজ করতেছে ওরা আমাদেরই লোক। আমাদেরই কর্মী। এই জন্য চাচ্ছি অন্যদের মাধ্যমে জিনিসগুলা বন্ধ করে দেয়া যায় কি না।’
ধামরাই উপজেলা বন কর্মকর্তা মোতালেব আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছর আগে আমরা ভাইঙা দিয়েছিলাম। পরে আমার বদলি হওয়ায় আমি চলে গিয়েছিলাম। সম্প্রতি আমি আবার এখানে জয়েন করেছি। আমি ইউএনও স্যারকে জানিয়ে এটা ভেঙে দেব। আগামী সপ্তাহে ইনশাল্লাহ আমরা ওটা ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করব।’