করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছরে দেশের শিল্প খাত সংকুচিত হয়ে পড়ে। শিল্প স্থাপনে ব্যবহৃত মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি তলানিতে পৌঁছে। এতে মারাত্মক ব্যাহত হয় শিল্পোৎপাদন। বিরূপ প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে।
সেই আঁধার কেটে নতুন বছরে জেগে উঠছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধানতম চালিকাশক্তি ম্যানুফাকচারিং বা উৎপাদনমুখী শিল্প খাত।
অর্থনীতিবিদ ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলেছেন, আশার কথা হচ্ছে, ক্যাপিটাল ম্যাশিনারিজ (মূলধনি যন্ত্রাংশ) ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে। এটি বিনিয়োগবান্ধব লক্ষণ।
স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি।
গত পাঁচ মাসে আমদানি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ৩০ শতাংশ এবং কাঁচামাল আমদানি প্রায় শতভাগ বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ার অর্থই হচ্ছে দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে যে বিনিয়োগে খরা চলছে, তা কাটতে শুরু করা। অর্থনীতির জন্য এটি ইতিবাচক লক্ষণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের চেয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে মাঝারি ও বড় শিল্পে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে চামড়া খাতে। গত জুলাই-নভেম্বরে চামড়া ও চামড়াজাত খাতে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয় ১২৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বস্ত্র খাতে উৎপাদন বেড়েছে ১৫ শতাংশ, টেক্সটাইলে ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ। ওষুধশিল্পে বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এই চিত্র বলে দিচ্ছে উৎপাদমুখী শিল্প খাতে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা ছিল। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে সেটার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। করোনার কারণে দেশের যেসব শিল্পোদ্যোক্তা বসে ছিলেন, তারা এখন নতুন নতুন শিল্প ইউনিটের সম্প্রসারণ করতে শুরু করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে।
তবে ওমিক্রন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে ১৬০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় ১২৭ কোটি ডলারের। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৩৯ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালে সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে শিল্প খাত টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ খাত।
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, আলোচ্য অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে শিল্প খাতে ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ১৫৭ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৯ কোটি ডলার।
একই সময়ে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি হয় ১ হাজার ৮২ কোটি ডলার, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৭৩০ কোটি ডলার।
গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার কম। ফলে শিল্প খাত ওমিক্রনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আগামী দিনে শিল্প খাতে গতি আরও বাড়বে।’
করোনার ধাক্কায় শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে আমদানি ও শুল্ক আদায় ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি শুল্ক আদায় বেড়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এই সময়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক আদায় হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি ।
শিল্প খাত জেগে ওঠার একটি বড় ইঙ্গিত হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের মধ্যে শিল্পোৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত বছর যে এলসি খুলতে লেগেছিল ১০০ টাকা, এখন তা খুলতে লাগছে ১৩০ টাকা। এ কারণে ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই সব দেশ থেকে কিছু বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসছে। ফলে বাংলাদেশি কিছু উদ্যোক্তা নতুন ইউনিট সম্প্রাসরণের দিকে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
ডিসিসিআই-এর সাবেক এই নেতা আরও বলেন, ‘যেভাবে আশা করেছিলাম বিনিয়োগ বাড়বে, ওই ভাবে গতি দেখা যাচ্ছে না। করোনায় যেসব সমস্যায় আমরা পড়েছিলাম, তা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারিনি এখনও। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ আপাতত নেই। ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রচুর অর্ডার আসছে। তবে ওমিক্রন দীর্ঘস্থায়ী হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।