মেসে থাকার সামর্থ্য না থাকায় অন্যের সহায়তার এক বাড়িতে ফ্রি থাকেন বগুড়ার শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী আলমগীর কবির। আর্থিক অনটনের কারণে তিনবেলা তার ঠিকমতো খাওয়া হচ্ছিল না। দিন দিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এই কারণে উপায় না দেখে আশ্রয় নেন ‘বিজ্ঞাপনের’। দেয়ালে সাঁটানো বিজ্ঞাপনে তিনি জানান, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’
দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো সেই বিজ্ঞাপনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন এক ব্যক্তি। এর পর থেকে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় পোস্টটি।
পোস্টটি ছড়িয়ে পড়লে আলমগীর কবির নিজেই বিব্রত অবস্থায় পড়েন। তিনি জানান, ফেসবুকে ওই পোস্ট তিনি করেননি। কেউ একজন করেছেন।
৩২ বছর বয়সী আলমগীর কবির বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। তিনি বগুড়া শহরের জহুরুলনগর একতলা মসজিদ এলাকার পাশের একটি বাড়িতে থাকেন।
আলমগীর বলেন, ‘একা থাকার জন্য তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা কষ্টকর হচ্ছিল। তাই বাসার আশপাশে ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। এতে আমার খাবারের চাহিদা পূরণ হতো। বাজার ও রান্নার ঝামেলাও কমত। কিন্তু কে যেন এটি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেয়। এর পর থেকে এটি সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।’
তিনি জানান, মানুষ বিষয়টি বাজেভাবে উপস্থাপন করছে। অনেকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে বলছে। কিন্তু এটা সরকারের কোনো ব্যর্থতার বিষয় নয়। মানুষ না বুঝেই বিভ্রান্ত করছে।
তিনি বলেন, ‘এমনকি অনেক সংবাদমাধ্যমে আমার এই বিষয়ে নিউজ করেছে। কিন্তু তারা কেউ আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি।’
নিজে না খেয়ে থাকার মতো অভাবী নন বলে উল্লেখ করেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন একটি টিউশনি করে দেড় হাজার টাকা পাই। এটা দিয়ে আমার খাওয়া খরচ হবে। কিন্তু ঢাকায় পরীক্ষা দিতে গেলে টাকা লাগবে। একবার ঢাকায় গেলে সারা মাসে আমি খাব কী? কিন্তু টিউশনির বিনিময়ে দুই বা তিনবেলা ভাতের ব্যবস্থা হলে আমি নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিতে ঢাকায় যেতে পারব।’
আলমগীর হোসেনের এই বিজ্ঞাপন ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে
কথোপকথনে জানা যায়, ১৯৯০ সালের ২০ মে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার শরাইল গ্রামে আলমগীর কবিরের জন্ম হয়। ২০০৭ সালে নিজ এলাকার শরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের কবির এসএসসি পাস করেন।
পল্লি চিকিৎসক মো. কফিল উদ্দিন ও আম্বিয়া বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে আলমগীর সবার ছোট।
বড় সন্তান রুহুল আমিন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। কবিরের বড় তিন বোন রুপালি, নূরজাহান ও সুরাইয়া। স্বামী সম্পর্ক ছেদ করার পর নূরজাহান তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন।
তবে আলমগীরদের অল্প কিছু জমি আছে। এতে তাদের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটে যায়।
আলমগীর বলেন, ‘আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে টিউশনি করাতাম। রেজাল্ট ভালো হওয়ায় শিক্ষকরা টিউশনি কমিয়ে পড়ালেখায় বেশি করে মনোনিবেশের পরামর্শ দেন। আমার শিক্ষকরাও বইসহ বিভিন্ন কিছু দিয়ে সহায়তা করেন।’
চাকরি বিষয়ে আলমগীরের সঙ্গে কথা হয়। বলেন, ‘বাবা বলেছিলেন সরকারি চাকরির চিন্তা করো না। এখন যা পাও, তাই করো। তার কথায় ঢাকায় গিয়েছিলাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাগুলোয় পাস করি। কিন্তু যাওয়ার পরে বলে, আপনার তো অভিজ্ঞতা নেই।
‘পরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করলাম। চাকরি হলো একদম ছোট পদে। বেতনও কম। মাত্র ৮ হাজার টাকা। পড়ার সময় পেতাম না, চাকরির পরীক্ষার দিন ছুটি পেতাম না। এ জন্য ছেড়ে দিই।
‘পরে আবার বগুড়া ফিরে আসি। কিন্তু মেসে থাকাতে খরচ বেশি হচ্ছিল। ওই সময় জহুরুলনগরের পরিচিত এক আপুর কাছে বাসস্থানের সমস্যার কথা জানাই। ওই আপুর বাবা তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এই বাসায় তারা কেউ থাকেন না। তারা ঢাকায় থাকেন। পুরো বাসাটিতে আমি একা থাকি।’
তিনি বলেন, ‘তখন আমার মনে হলো এলাকার কেউ ভাতের বিনিময়ে টিউশনি পড়াতে দিলে আমার খাওয়ার সমস্যা দূর হতো। এমন আইডিয়া থেকে বিজ্ঞাপন দিই।’
কথোপকথনের শেষ দিকে আলমগীর কবির বলেন, ‘আমি ছোট থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছি। কারও অনুদানের প্রয়োজন নেই। মাস্টার্স পাস করেছি। এখন চাকরি নেই। কিন্তু একটা সময় অবশ্যই চাকরি পাব। চাকরির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পরীক্ষাও দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুবেলার খাবারও আমি এমনি চাইনি। পড়ানোর বিনিময়ে চেয়েছি। এটা খুবই স্বাভাবিক চাওয়া। কিন্তু মানুষ এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে, এখন লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।’