ব্যবসায়ীদের একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীই করোনার প্রভাব মোকাবিলা ও সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বেশির ভাগ সুবিধা পেয়েছে। এর বিপরীতে অনানুষ্ঠানিক খাতের যেসব জায়গায় এ সুবিধা পৌঁছানো দরকার ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্রণোদনা বণ্টনের আগে এই সুবিধা কারা পাবেন, সেটি সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি বলে এমন হয়েছে।
এ সমস্যা বাদ দিলে তাৎক্ষণিক উদ্যোগের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে বলেই অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় শনিবার বক্তারা এ মতামত দিয়েছেন। আলোচনার শিরোনাম ছিল- ‘কোভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজ: প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’।
এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও গবেষণা সংস্থা র্যাপিড যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
মূল প্রবন্ধে র্যাপিডের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. এম এ রাজ্জাক জানান, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির ৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ গত ডিসেম্বরে ২২তম অবস্থানে ছিল, চলতি জানুয়ারিতে যদিও কিছুটা নেমে ২৯তম হয়েছে। এই অবস্থানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকারের উদ্যোগগুলোর প্রভাব। সেই বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংশিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পরই ২৫ মার্চ সরকার রপ্তানি খাতের কর্মীদের বেতন দেয়ার জন্য মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল ঘোষণা করে। এরপর করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতের জন্য পর্যায়ক্রমে ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এসব প্যাকেজে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা জড়িত, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ।
সরকার ঘোষিত প্যাকেজের ৮৫ শতাংশ মুদ্রাবাজারকেন্দ্রিক, অর্থাৎ ব্যাংক ঋণনির্ভর। তবে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা বেশি গেছে সংগঠিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। তুলনামূলকভাবে অনানুষ্ঠানিক খাতের মাঝারি, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান তা ঠিকভাবে পায়নি। পর্যটন খাতে প্রণোদনা পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়েছে। দুস্থদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই নীতি সুবিধা কার প্রয়োজন, সেটি চিহ্নিত করার কাজটিও ঠিকভাবে হয়নি। প্রণোদনা প্যাকেজগুলোয় গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, ফার্ম মেকানাইজেশনের মতো এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা করোনার প্রভাব মোকাবিলার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কঠিন। এর অন্যতম কারণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।
এ পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে দ্রুত সংস্কার আনারও পরামর্শ রাখেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে দাবি করেন, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি দূর করতে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘যেকোনো জরুরি বা সংকটময় পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিরোধ উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার ক্ষেত্রে সরকার সেটিই করেছে। এটি ব্যাংক খাতের মাধ্যমে করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও তাই করেছে। সুবিধা কারা পাবে, তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। তবে পরে সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য সমস্যা সমাধান করা। সেটিই করছে সরকার।’
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য কাওসার আহমেদ বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমানে যেসব সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো যথার্থভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের মধ্যেই হাউজহোল্ড সার্ভে প্রকাশ করা সম্ভব হবে, যা তথ্যের ঘাটতি দূর করতে সহায়ক হবে।’
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সবার জন্য পেনশন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য বিমা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা প্রণোদনা সুবিধা পায়নি বা সমস্যায় রয়েছে তাদের সুবিধা দেয়ার কাজ চলছে।’
ইস্টার্ন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজের বড় অংশ ব্যাংক খাতের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি প্রশমনে একটি উদ্যোগ থাকা দরকার। নতুবা প্রাতিষ্ঠানিক যে আগ্রহ সেটা কমে যেতে পারে।’
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘শুধু সক্ষমতা বাড়ালে হবে না, প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে ছোট, অতি ছোটদের পাশে থাকে। কার কী সুবিধা দরকার, সেটি এসডিজি বিষয়ক লোকালাইজেশন কর্মসূচি থেকে সহজে বের হয়ে আসবে। ফলে এসডিজির তথ্যগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক নূরুল আলম বলেন, ঋণ ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা এখন জরুরি।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে। কিন্তু সেখানে যার প্রয়োজনীয়তা বেশি, সে সুবিধা পাচ্ছে কি না সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলো কম ঝুঁকি বিবেচনা করেই গ্রাহক নির্বাচন করছে। যে প্রতিষ্ঠান ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে, আর যে প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে, এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানেরই আগে প্রণোদনা পাওয়া উচিত। কিন্তু ব্যাংক ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তকে গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।’
এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ খুবই সমযোপযোগী ছিল। ফলে আর্থসামাজিক খাতে করোনার প্রভাবের যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা প্রভাব পড়েনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসূফ বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর কারণে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সহজ হয়েছে। তবে এই প্যাকেজগুলোকে আরও কার্যকর করা যেত কি না বা আগামীতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, কীভাবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে প্রাপ্যতা নির্ধারণ করা যায়, সেসব নিয়ে এখন কাজ করা দরকার। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।
ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।