ব্যাপক পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের শুধু একটি ইউনিট থেকেই। সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিট ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি থানা থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানানোর।
ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর শাখার অন্তত ২০ জন নেতার কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়েছে নিউজবাংলা।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতারাও এসব অভিযোগের বিষয়ে জানেন। তারা অনেকে মৌখিক ও লিখিতভাবে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেছেন ব্যবস্থা নিতে।
অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ টাকার বিনিময়ে ওই ইউনিটের অধীন বেশ কিছু থানা কমিটি করেছেন।
ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একটি থানার নেতৃত্ব আসা এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি নিজে নেতা হতে গত তিন বছরে প্রায় ২০ লাখের মতো টাকা দিয়েছেন। এ টাকা তিনি দিয়েছেন মহানগর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। এর মধ্যে ৮ লাখ টাকা এককালীন নগদ দিয়েছেন। তার বক্তব্যের অডিও নিউজবাংলার কাছে আছে।
তিনি বলেন, ‘মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টাকা ছাড়া নেতা বানান না। এ জন্য এ খরচ করেছি।’
আরও বেশ কয়েকটি থানা থেকে টাকার বিনিময়ে নেতা বানানোর অভিযোগ এসেছে নিউজবাংলার কাছে।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের এই ইউনিটের থানা কমিটিগুলোয় যাদের নেতা বানানো হয়েছে, তাদের কারও কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার কম নেওয়া হয়নি। তবে অনেকের কাছ থেকে এর দ্বিগুণ টাকাও নেওয়া হয়েছে।’
টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ী-বিবাহিতদের পদায়ন
অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৯টি ইউনিটে টাকার বিনিময়ে পদ দিয়েছেন মেহেদী হাসান ও জুবায়ের আহমেদ। এসব কমিটির নেতৃত্ব আনা হয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিদের। ওই থানাগুলোয় কমিটি দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী, অছাত্র, সাবেক ছাত্রদল ও বিবাহিতদের দিয়ে। এসব পদায়নে হয়েছে বিপুল টাকার লেনদেন।
নতুন যে ৯টি থানায় কমিটি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো গেন্ডারিয়া, চকবাজার, টিঅ্যান্ডটি মাদ্রাসা, বংশাল, দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লালবাগ, খিলগাঁও, রমনা ও শ্যামপুর।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক সাবেক নেতা নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা টাকার বিনিময়ে অনেককেই থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। এটা এখন ছাত্রলীগে ওপেন সিক্রেট।’
ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, কয়েকটি থানার একাধিক নেতার কাছে থেকে টাকা নিয়ে কমিটি বাণিজ্য করছে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে সবাইকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বানানো সম্ভব হয়নি। অনেকে এখনও তাদের কাছে টাকা ফেরত নেয়ার জন্য ঘুরছেন।
টাকা নিয়েছেন এমন কয়েকজনের বেশ কয়েকটি অডিও রেকর্ড সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন, যার একটিতে প্রতীয়মান হয়, ছাত্রলীগের রমনা থানার সাবেক সভাপতি সোহেল হোসেন লিমন টাকা লেনদেন নিয়ে কথা বলছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসানের সঙ্গে।
এ কল রেকর্ডে মেহেদী বলছেন, ‘তোমার কাছে কত আছে, অ্যামাউন্ট?’ তখন লিমন বলছেন, ‘১ লাখ।’ অন্যদিক থেকে মেহেদী বলছেন, ‘আমি একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দিচ্ছি, ওই নম্বরে টাকা দিয়ে দাও।’
অন্য একটি কল রেকর্ডে লিমন বলছেন, ‘ভাই।’ অন্যদিক থেকে মেহেদী বলছেন, ‘বেসিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দে।’ তখন লিমন বলেন, ‘অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দেন।’ অন্যদিক থেকে মেহেদী বলেন, ‘আমি তো এসএমএস করছি তোকে। আর শোন, জমা দিয়ে আমাকে ফোন দিস আর স্লিপটা নিবি।’ অন্য একটি কল রেকর্ডে লিমন বলেন, ‘ভাই, এই যে শান্তিনগর ব্র্যাঞ্চে জমা দিয়ে দিছি।’ তখন মেহেদী বলেন, ‘মানি রিসিট?’ লিমন অন্যদিক থেকে বলেন, ‘মানি রিসিটগুলো বাসায় গিয়ে পাঠাই।’
তবে মেহেদী ওই টাকা তার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিয়েছেন বলে দাবি করেন লিমন। তিনি বলেন, ‘সেবার উনি যে টাকা চেয়েছিলেন, সেটা ধার হিসেবে নিয়েছিলেন। তবে টাকা না দিলে কমিটি ভেঙে দেবেন এমন হুমকি আমাদের দিয়েছিলেন, সেটা পরে।’
তিনি বলেন, ‘উনি আমার কাছ থেকে প্রথমে একটি মোবাইল গিফট নিয়েছিলেন। আমি যখন থেকে রাজনীতি করি ওনার মতো নেতা পাইনি, যে ওনার মতো করে।’
উনি কী করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনি হাতে সুন্দর মোবাইল দেখলে বলতেন, আমাকে একটা মোবাইল গিফট কর। না দিলে চাপ দিতেন।’
লিমন বলেন, ‘আমাদের কমিটি ভেঙে দেওয়ার আগে উনি (সভাপতি মেহেদী হাসান) আমাদের কাছে টাকা চেয়েছিলেন, না দিলে ভেঙে দেবেন।’
লিমনের এ কল রেকর্ড নিউজবাংলার কাছে রয়েছে।
ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতার অভিযোগ, ডেমরা ছাত্রলীগের কমিটিতে জয়নাল আবেদিন সৌরভকে সভাপতি করা হয়েছে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে। ওই থানার সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে আসিফ খানকে, তার কাছ নেয়া হয়েছে ৭ লাখ টাকা। বংশালে সদ্য সভাপতি হওয়া ফেরদৌস মিয়া ৫ লাখ টাকা নগদ ও ৫ লাখ টাকার চেক দিয়েছেন।
চকবাজার থানা ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি শাওন হোসেন। এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিয়েও করেছেন। ছাত্রলীগের কদমতলী থানার আহ্বায়ক করা হয়েছে আনোয়ার হোসেন আনুকে, যিনি একজন ডিশ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। যাত্রাবাড়ীতে অর্থের বিনিময়ে সভাপতি করা হয়েছে আতিকুর রহমান খানকে।
ক্ষুদ্ধ আওয়ামী লীগও
মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার এই পদ বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে অভিহিত ওই ইউনিটের আওয়ামী লীগ নেতারাও। এদের অনেকে নিউজবাংলার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কেউ পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়টি জানার পর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছি। (সম্প্রতি হওয়া ৯ কমিটিতে) এমন অছাত্র, বিবাহিতদের দিয়ে তো আর ছাত্রলীগ চলতে পারে না।’
ছাত্রলীগ নেতাদের পদ-বাণিজ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে বলেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমরা জেনেছি। সবকিছু তো আর ফোনে বলা যায় না।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কমিটি-বাণিজ্য করছেন, এমন অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও কথা বলেছি।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আবার যদি দলের দুর্দিন আসে, তাহলে এই ছাত্রলীগ দিয়ে কী হবে? এদের দিয়ে তো আন্দোলন-সংগ্রাম সম্ভব হবে না। এ জন্য যারা দায়িত্বশীল তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ধীরে ধীরে সংগঠনটি শেষ হয়ে যাবে।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান নিউজবাংলার কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। দেখেন কোনো সত্যতা পান কি না।’
তিনি বলেন, ‘কেউ চাকরি পেলে অনেকে বলে টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। যারা পোস্ট পায় না, তারা এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো এমনি এমনি কমিটি করি না। যারা মাঠে খাটে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলে কমিটি করি।’