শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দিতে সরকারের তৎপরতা শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।
তবে মন্ত্রণালয় থেকে সম্ভাব্য নতুন উপাচার্যের কোনো তালিকা ইউজিসিতে পাঠানো হয়নি। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে বলা হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথাতেও তেমন ইঙ্গিত ছিল।
বিষয়টি নিশ্চিত হতে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। ইউজিসির একজন সদস্য নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আভাস পাওয়া গেছে। তাকে অপসারণ করা হবে নাকি পদত্যাগ করতে বলা হবে, সে বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার।’
এ ক্ষেত্রে ইউজিসির বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘শাবিপ্রবিতে নতুন উপাচার্য নিয়োগে সরকার সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিনজনের একটি তালিকা মঞ্জুরি কমিশনে আসার কথা। তবে এমন কোনো তালিকা আমরা এখনও পাইনি। উপাচার্য নিয়োগের যে তালিকা পাঠানো হয়, সেখানে ইউজিসি শুধু মতামত প্রদান করে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আসেনি।’
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘উপাচার্যকে সরানো হবে কি না, সেটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিষয়। আমি সেটি নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে অনশনে শাবি শিক্ষার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা
শাবিপ্রবির উপাচার্যকে সরিয়ে দিতে পূর্বসূরিদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে।
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হতে পারে। তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিলে তা গ্রহণ করতে পারেন রাষ্ট্রপতি।’
উপাচার্যের বিদায়কে সম্মানজনক করতেই এ পথ বেছে নেয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন করা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় আসতে পারে এমন ঘোষণা।
একজন উপাচার্যকে কোন প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা যায়, তা জানতে চাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামানের কাছে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়োগপত্রেই বলা থাকে: আচার্য যেকোনো সময় চাইলে তাকে অপসারণ করতে পারেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, উপাচার্যদের বিদায়কে সম্মানজনক করা কিংবা একজন উপাচার্যকে অসম্মান করতে না চাইলে তখন পদত্যাগ করতে বলা হয়। তিনি পদত্যাগপত্র পাঠালে সেটি আচার্য গ্রহণ করেন।’
তিনি বলেন, ‘তবে আচার্য চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো উপাচার্যকে রিমুভ করতে পারেন।’
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পাশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক। ছবি: নিউজবাংলা
কে হচ্ছেন নতুন উপাচার্য
শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে নেয়া হতে পারে এমন আলোচনা বৃহস্পতিবার থেকে চাউর হয়েছে ক্যাম্পাসে। পরবর্তী উপাচার্য কে হতে পারেন, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। যদিও এ বিষয়ে শিক্ষকদের কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি।
অনশন ভাঙানোর সময় মুহম্মদ জাফর ইকবালও আশ্বাস দেন, শিক্ষার্থীদের দাবি সরকার মেনে নেবে। সরকারের উচ্চমহল থেকে তাকে এই আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে জানান জাফর ইকবাল।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই কাউকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে। পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে দুজনের নাম আলোচিতও হচ্ছে। তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম এবং শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস।
এ দুজনের মধ্য থেকে একজনকে পরবর্তী উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে। ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেয়ার আগেও উপাচার্য হিসেবে এ দুজনের নাম আলোচিত হয়েছিল।
তবে এমন কিছু জানেন না জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ রকম কিছু আমি শুনিনি। বর্তমান উপাচার্যকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে কি না তাও আমার জানা নেই।’
শাবির ফটকে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের অবরোধ। ছবি: নিউজবাংলা
উপাচার্যের দায়িত্ব দিলে গ্রহণ করবেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তুলসী দাস বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ সরকারের বিষয়। এ বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই।’
নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘একজন উপাচার্য দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি চলে যাবেন বলে কিছু আমি শুনিনি। নতুন উপাচার্যের ব্যাপারে কোনো আলোচনাও আমি শুনিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে নেয়া হতে পারে বা তিনি পদত্যাগ করতে পারেন এমন আলোচনা রয়েছে। তাকে সম্মানজনকভাবে সরানোর পথ হয়তো খোঁজা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককেই উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়াটা ভালো। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সবকিছু জানা থাকলে তার পক্ষে পরিচালনা করাটা সহজ।’
ওই শিক্ষক বলেন, ‘উপাচার্য হিসেবে যে দুজন শিক্ষকের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা শিক্ষকদের আওয়ামীপন্থি একটি প্যানেলের নেতা। যদিও আনোয়ারুল হক ট্রেজারারের দায়িত্ব নেয়ার পর আর সরাসরি কোনো বলয়ের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে আগে এই প্যানেলে সক্রিয় ছিলেন। একটি বলয়ের নেতা হওয়ায় তাদের পক্ষে সর্বজনীন হয়ে ওঠা কতটা সম্ভব হবে এবং অন্য প্যানেলের শিক্ষকরাইবা কতটা মেনে নেবেন- এ নিয়ে সন্দেহ আছে।’
কে নতুন উপাচার্য হতে পারেন, এটি এখনকার আলোচ্য বিষয় নয় বলে উল্লেখ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, ‘আমরা চাই উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ। তাকে আর এক দিনও আমরা ক্যাম্পাসে দেখতে চাই না। এই দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।’
২০১৭ সালের আগস্টে প্রথম দফায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ২০২১ সালের ৩০ জুন উপাচার্য পদে তাকে তিন বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
৫০ বছরে মাত্র একবারই উপাচার্য অপসারণ
উপাচার্য নিয়োগ বা অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হলেও অপসারণের নজির খুব একটা নেই। দেশের ৫০ বছরে ইতিহাসে একজন উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছিল।
সেটাও তিন দশক আগের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনকে ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রশিবিরের আন্দোলনের মুখে অপসারণ করেন রাষ্ট্রপতি।
তবে পদত্যাগের উদাহরণের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শাসনের গত ১৩ বছরে পাঁচজন উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। তাদের সবাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন।
২০০৮-এ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর পরই উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে মুখর হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ওই সময়ের উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ।
২০১২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে খুন হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদ। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনে যুক্ত হন শিক্ষক-কর্মচারীরাও। সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ডাকেন।
উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পেলেও তাকে আর নিয়োগ দেননি রাষ্ট্রপতি। সে সময় নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। ছবি: ফেসবুক
বছর না গড়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় আবারও উত্তাল হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায় সব পন্থির শিক্ষক মিলে গড়ে তোলেন আন্দোলনে। একপর্যায়ে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।
২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পড়েন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ১১ এপ্রিল ছুটিতে যান তিনি। ২৭ মে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছুটিতেই ছিলেন।
২০১৯ সালেই আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার ঘটনায় উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি।
শাবিতে আন্দোলনের শুরু যেভাবে
শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু ১৩ জানুয়ারি। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী।
১৬ জানুয়ারি বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে উপাচার্যকে মুক্ত করে পুলিশ। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ সে সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। শিক্ষার্থীরাও ইট-পাটকেল ছোড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অর্ধশত আহত হন।
সে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন নামেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, উপাচার্যই পুলিশ ডেকে তাদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। এ কারণে তারা উপাচার্যের পদত্যাগ চান। বাসভবনের সামনে অবস্থানের কারণে গত ১৭ জানুয়ারি থেকেই অবরুদ্ধ ছিলেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
১৯ জানুয়ারি বেলা ৩টা থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী।
দাবি আদায়ে সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে ২৬ জানুয়ারি অনশন ভাঙেন শিক্ষার্থীরা।