অনিয়ম আর দুর্নীতি অনেকটাই নিয়মে পরিণত করেছে রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। শিক্ষকদের নিয়ে ক্লাস-বাণিজ্য চলে খোলামেলা। শিক্ষক এমপিওভুক্তিতেও হয় অর্থের লেনদেন। আর এসব অনিয়ম ঘেঁটে যে কেন্দ্রীয় চরিত্র পাওয়া যায়, তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইন। তার সঙ্গে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে কম বেতনের খণ্ডকালীন শিক্ষকদের সম্মানীতেও আছে অনিয়ম আর ছলচাতুরি। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য দোকান। কাগজে-কলমে আয়তন কম দেখিয়ে অবৈধভাবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জমিতে দোকান বরাদ্দের মাধ্যমে বছরের পর বছর চলছে ভাড়া-বাণিজ্য।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, লেখাপড়া দেখভালের চেয়ে এসব কাজ নিয়েই প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইনের বেশি ব্যস্ততা। ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে আঁতাত করে ঐতিহ্যবাহী স্কুলটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন তিনি। অনিয়মকে নিয়ম বানাতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যতটা তৎপর, ঠিক ততটাই উদাসীন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া আর প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষার উদ্যোগে।
ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও জেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মাধ্যম থেকেই কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে প্রধান শিক্ষক বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখার উদ্যোগটুকুও নেয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব অভিযোগের তীর বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ঘিরে; যার নেপথ্যে কলাকাঠি নাড়ছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের কয়েকজন জানান, বিদ্যালয়টি পরিচালনার ক্ষেত্রে একদিকে প্রধান শিক্ষক ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, অন্যদিকে তথাকথিত নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমেও রাখছেন স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা। দিনের পর দিন প্রধান শিক্ষকের এমন কর্মকাণ্ডে বিদ্যালয় ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হলেও অজ্ঞাত কারণে চুপ থাকছেন দায়িত্বশীলরা।
ব্যবস্থাপনা কমিটি নিশ্চুপ থাকার নেপথ্য কারণও অনুসন্ধান করা হয়েছে। তাতে উঠে এসেছে আরেক তথ্য। জানা গেছে, এ কমিটির নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি পরিবার।
তথাকথিত নির্বাচন ও সমাঝোতার মাধ্যমে ওই পরিবারের লোকজনই ঘুরেফিরে ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে আসছে। আর এতে সব রকম সহায়তা দিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক। এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রধান শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি একে অন্যের সহযোগী। ফলে কেউ কারও বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটুকুও করে না।
এসব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার প্রভাব পড়েছে সার্বিক শিক্ষাদানেও। দিন দিন শিক্ষার্থী কমতে থাকায় বিদ্যালয়টি এখন পরিচালন সংকটে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ পরীক্ষায় খাতা টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পদটি বাগিয়ে নেন আহমাদ হোসাইন। এরপর ‘বিশেষ কায়দায়’ ধর্ম শিক্ষক থেকে বাংলার শিক্ষক হয়ে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করান এমপিওভুক্তির তালিকায়। এর পরই বিদ্যালয় পরিচালনায় তার স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়। চালিয়ে যেতে থাকেন একের পর এক অনিয়ম।
এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও জেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করা হয়েছে। সেসব অভিযোগের অনুলিপি নিউজবাংলার হাতেও এসেছে। কিন্তু কোনো মাধ্যম থেকেই এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে প্রধান শিক্ষক বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখার উদ্যোগটুকুও নেয়া হয়নি।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইন এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালে ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অবসরে গেলে কপাল খুলে যায় আহমাদ হোসাইনের। তিনি যখন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেন, তখন তিনি ছিলেন একজন নন-এমপিওভুক্ত ধর্ম শিক্ষক।
এরপর ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক চেয়ে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণের অন্তত ১৫ দিন আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মেয়াদ ছিল মাত্র চার দিন।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ পরীক্ষায় খাতা টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পদটি বাগিয়ে নেন আহমাদ হোসাইন। এরপর ‘বিশেষ কায়দায়’ ধর্ম শিক্ষক থেকে বাংলার শিক্ষক হয়ে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করান এমপিওভুক্তির তালিকায়। এর পরই বিদ্যালয় পরিচালনায় তার স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়। চালিয়ে যেতে থাকেন একের পর এক অনিয়ম।
প্রধান শিক্ষক হওয়ার নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আহমাদ হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়োগ পরীক্ষায় খাতা টেম্পারিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর এমপিওভুক্তির বিষয়ে যে দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আমার কোনো হাত নেই। কারণ এমপিও করে মাউশি আঞ্চলিক অফিস।’
এ বিষয়ে মাউশির পরিচালক (বিদ্যালয়) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘অভিযোগগুলো গুরুতর। আমি অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
বিদ্যালয় পরিচালনায় প্রধান শিক্ষকের অনিয়মের অভিযোগের তালিকা বেশ দীর্ঘ। তিনি চান বিদ্যালয়ে ঘন ঘন শিক্ষক নিয়োগ হোক। আর কর্মরত খণ্ডকালীন শিক্ষকরা চলে যাক। উদ্দেশ্য, নতুন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া। করোনার মধ্যে কিছুদিন আগে স্কুলের খণ্ডকালীন কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকার পাওনা পরিশোধ না করেই জোরপূর্বক স্কুল থেকে বের করে দেন তিনি।
প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়মের বাইরে গিয়ে আমি কিছু করিনি। আর দোকান বরাদ্দের বিষয়ের আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক খণ্ডকালীন শিক্ষক বলেন, ‘তার (প্রধান শিক্ষক) চাপের কারণে তিনজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন। বাকি যারা ছিলেন তাদের ক্লাস-রুটিনে রাখা হয় না। ২০১৮ সাল থেকে আমাদের কোনো ক্লাস দেয়া হয় না। এমনকি খণ্ডকালীন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তিন-চার মাস পর পর এক মাসের বেতন দেয়া হয়। এসএসসি কোচিং এবং মডেল টেস্টের নামেও পরীক্ষার্থীদের থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আহমাদ হোসাইন দাবি করেন, নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি কিছু করেননি। নিয়মের ভেতরেই সবকিছু করা হয়েছে।
স্কুলের জায়গা কম বরাদ্দ দেখিয়ে বেশি ভোগ করতে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এর সত্যতাও মিলেছে। দেখা গেছে, স্কুলের সঙ্গে পূর্ণিমা রেস্তোরাঁ হোটেলটি কার্যকরী পরিষদ ৯ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট দৈর্ঘ্য হিসেবে বিক্রি করেছে। কিন্তু সেখানে দখল দেয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গা। অথচ এ বাড়তি বরাদ্দের টাকা বিদ্যালয়ের তহবিলে যায়নি কখনই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘দোকান বরাদ্দের বিষয়ের আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ কারা সংশ্লিষ্ট এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে যাব কেন?’
সরাসরি না বললেও প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির দিকেই উঠেছে অভিযোগের তীর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য গৌরাঙ্গ মোহন রায় বলেন, ‘আপনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’